ঘটনাটা কয়েক দশক আগের। নিকোলাস ফিলিপ। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। থাকেন প্যারিসের অভিজাত এলাকায়। সদ্য চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। চাকুরিজীবন শেষ হওয়ার কিছুদিনের মাথায় স্ত্রী মারা গেছেন। বিপত্নীক হওয়াতে এখন তিনি ঝাড়া হাত-পা। একটি কন্যা সন্তানের জনক। মেয়ে অলিভিয়া বেশ ভাল। কাজেরও। বাবাঅন্তপ্রাণ।
-
চাকুরির শেষ দিকে মশিয়ে ফিলিফি মাগরিব বা মরক্কো নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করেছিলেন। পরিবারের সদস্যদের কৌতূহলের অন্ত নেই! তিনি এতকিছু ফেলে মরক্কো নিয়ে পড়লেন? মশিয়ে ফিলিপ সবাইকে বুঝ দিয়েছেন:
-আমি তরুণ বয়েসে সেখানে ছিলাম না! আমার প্রথম পোস্টিং মরক্কোতেই ছিল, সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন!
-
বিশ শতকের গোড়ার দিকেই মরক্কোতে ফরাসীদের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। ১৯১২ সালে আনুষ্ঠানিক সামরিক আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মরক্কোতে ফরাসি উপনিবেশ ছিলো। আলজেরিয়া ও মরক্কোতে ফরাসিদের একটা চোখ সব সময় ‘বারবার’ জনগোষ্ঠীর প্রতি নিবদ্ধ ছিল। আরবীতে এদেরকে ‘আমাযীগ’ বলা হয়।
আফ্রিকা ও স্পেনে ইসলামি হুকুমত বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা ছিল ‘আমাযীগ’দের। তারিক বিন যিয়াদ রহ., ইউসুফ বিন তাশাফীন রহ., বিশ্বের সর্বপ্রথম বিমানের চিন্তার উদ্ভাবক আব্বাস বিন ফিরনাস, ইবলে খালদুন, ইবনে বতুতা, ফরাসীবিরোধী মহান মুজাহিদ আবদুল করীম খাত্তাবী ও মহান মুজাহিদ আল্লামা আবদুল হামীদ বাদীস রহ. প্রমুখ ছিলেন এই জাতিগোষ্ঠীর।
-
নিকোলাস ফিলিপ তার গবেষণা কাজে সহযোগিতার জন্যে একজন সহকারী খুঁজছিলেন। ফরাসি জানে পাশাপাশি মরক্কোর বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাও জানে এমন! স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বেশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। তাই মরক্কোর নেশার প্রতি আরো বেশি ঝুঁকে পড়েছেন।
বাবাকে দিনরাত এই একটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে অলিভিয়া বেশ অবাক হলো। বাবা একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। তার মতো লোকেরা অবসর নেয়ার পর কতো সুন্দর করে জীবন কাটায়! তিনি কি না, এক অপরিচিত দেশ নিয়ে মেতেছেন! বলি বলি করে সুযোগ মেলে না। স্বামীসন্তানসহ বাবার বাসারই উপরতলার ফ্ল্যাটেই থাকে অলিভিয়া। এক ছুটির দিনে মশিয়ে ফিলিপ মেয়েকে কল করলেন:
-বাবা কিছু বলবে?
-হ্যাঁ, একটা কিছু বলার জন্যেই তোকে ডাকা! আমি তোকে একটা চাবি দিয়েছিলাম। ব্যাংক-লকারের! কোথায় সেটা?
-আছে, আমার কাছেই! তোমার কথামতো আমি কাউকে সেটার কথা জানাইনি! এমনকি মাকেও না।
-খুব ভালো করেছিস! চাবিটা এখন লাগবে!
-এত গোপন করে, এমনকি মাকেও লুকিয়ে কী রেখেছিলে লকারে? আমাকে বলা যাবে?
-তোকে না বললে আর কাকে বলবো মা! সরাসরিই বলি, তোর মা আমার বিয়ে করা প্রথম স্ত্রী নয়!
-কী বলছ আব্বু তুমি!
-হ্যাঁরে! সত্যি বলছি! সেটা আমার জীবনের এক অন্যরকম অধ্যায়! অন্ধকারও বলতে পারিস, আলোময়ও বলতে পারিস!
-মাকে জানিয়েছিলে?
-জানাতে চেয়েছিলাম! কিন্তু মন আগায়নি! আর তখন পরিস্থিতি এমন হয়ে গিয়েছিল, জানানোর মতো কিছু ছিল না বা জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। কারন আমি সেই ঘটনাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম প্রাণপণে। কিন্তু আজকাল মনে হয়, তোর মাকে জানালেই ভাল করতাম! মনে করেছিলাম সব ভুলে গেছি! সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে! এখন দেখছি, কিছুই মুছে যায়নি! আমি যে অন্যায় করেছি, সেটার প্রায়শ্চিত্ত করা ছাড়া আমার মুক্তি নেই।
-আব্বু তুমি সব শুরু থেকে খুলে বলো!
-চাকুরিজীবনের শুরুতেই আমার পোস্টিং পড়লো আলজেরিয়াতে। সেখান থেকে কিছুদিন পর পাঠিয়ে দেয়া হয় মরক্কোতে। সেখানে স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দমন করার জন্যে রিজার্ভ ফোর্স প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, মাগরিব অঞ্চলকে আর বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না, তাই বাইরে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে এই অঞ্চল ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। এজন্য কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল:
ক: স্থানীয় শিল্পগুলোকে যথাসম্ভব পঙ্গু করে দিয়ে যাওয়া।
খ: সমাজের বিভিন্ন স্তরে ফরাসি চিন্তাধারা গভীরভাবে প্রোথিত করে দিয়ে যাওয়া!
গ: শিক্ষাব্যবস্থা ও শিল্পসাহিত্যকে পুরোপুরি ফরাসীদের তাবে করে দিয়ে যাওয়া!
ঘ: একটা নতজানু সরকার ও পদলেহী সেনাবাহিনী তৈরী করে দিয়ে যাওয়া!
ঙ: যেখানে যত মূলবান পুরাকীর্তি আছে, সংগ্রহ করে নিয়ে আসা।
-
স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা বেশি ভয় করছিলাম বারবারদেরকে। তারা বেশ স্বাধীনচেতা ও যুদ্ধবাজ! এ-ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতায় স্পেনিশ সেনাবাহিনীও কাজ করেছে। বারবারদের ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে বেশি!
-
আমাদের দলের দায়িত্ব পড়েছিল এক বারবার অঞ্চলে। ওই এলাকাটা ছিল ‘হাতেবোনা গালিচার’ জন্যে বিখ্যাত। পুরো অঞ্চলের মহিলারা সারাদিন বসে বসে গালিচা বুনতো। অত্যন্ত দামী আর দুর্লভ এক শিল্প সেটা। হাজার বছর ধরে আমাযীগ নারীরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। চর্চা করে এসেছে। নিপুণতার চুড়ান্তশিখরে পৌঁছে দিয়েছে।
-
আমরা এলাকায় শিবির স্থাপন করেই কাজ শুরু করে দিলাম। পুরো গ্রাম কর্ডন করে চিরুনি অভিযান চালালাম। বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালানো হলো। অঞ্চলটা আপাতত বিদ্রোহের শংকামুক্ত হলো। নিয়মিত টহলে থাকলো সেনাদল। আমাদের অফিসার ছিলেন ধুরন্ধর ব্যবসায়ী বুদ্ধির অধিকারী! তিনি দেখলেন, এখানকার গালিচা বেশ সুন্দর! বাইরের ব্যবসায়ীরা গ্রামের বাজার থেকে কিনে নিয়ে যায়। অফিসার কায়দা করে বাইরের পাইকারদের আসা বন্ধ করলেন। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পীদের মাথায় হাত! বিক্রি করতে না পারলে খাবে কী? কিছুদিন এই অচলাবস্থা থাকলো। অবস্থা যখন সঙ্গীন আকার ধারণ করলো, তখন অফিসার তার খোলস ছেড়ে বের হলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন:
-নিরাপত্তাজনিত কারণে আমরা বাইরের লোককে এখানে আসতে দিতে পারি না, আবার তোমরাও বাইরে গেলে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়! তার চেয়ে বরং এক কাজ করা যাক, তোমাদের গালিচা আমরাই বড় পাইকারদের হাতে পৌঁছে দেবো!
গ্রামবাসী খুশি! এতো সাধু প্রস্তাব! শুরু হলো গালিচা সংগ্রহ করা! আমরা নামমাত্র মূল্য দিয়ে গালিচা সংগ্রহ করে সব বাক্সবন্দী করে প্যারিসের বাজারগুলোতে পাঠাতে শুরু করলাম। আশাতীত মুনাফা আসতে শুরু করলো। অফিসারের লোভ শতগুণ বৃদ্ধি পেলো। আমরাও তার ছিঁটেফোঁটা ভাগ পেতে লাগলাম।
-
নিয়মিত গালিচাসংগ্রহে যেতে যেতে গ্রামের মানুষের সাথে একধরনের সখ্যতা গড়ে উঠলো। মধ্যস্বত্বভোগীদের থেকে বাঁচার জন্যে আমি সেপাই নিয়ে নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে আনতাম! একটা বাড়ির গালিচার কথা সবাই বেশ প্রশংসা করতো, কিন্তু এখন পর্যন্ত ওবাড়ি থেকে একটা গালিচাও আমাদের হাতে আসেনি! খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, তারা আমাদের কাছে গালিচা বিক্রি করতে আগ্রহী নয়। ব্যাপারটা আমাদের সামরিক মেজাযের সাথে মানানসই নয়!
-
সিদ্ধান্ত হলো তারা স্বেচ্ছায় বিক্রি করতে রাজি না হলে জোর-জবরদস্তি করে বিক্রি করাতে বাধ্য করতে হবে। বেশি তেড়িবেড়ি করলে সব গালিচা বাজেয়াপ্ত করা হবে। আমাদের একজন স্থানীয় ইনফর্মার ছিল, সে ইশারা-ইঙ্গিতে এমন করতে নিষধ করলো, সে বললো:
-ঘরে তিনজন মহিলা থাকে। ঘরে কোনও পুরুষ নেই। বৃদ্ধা দাদী, একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা ও এক তরুনী। আমাযীগ মহিলারা কড়া পর্দানশীন না হলেও, এই পরিবার ভালভাবে পর্দা মেনে চলার চেষ্টা করে। দয়া করে তাদেরকে ছেড়ে দিন!
-নাহ, ছেড়ে দেবো কেন? অন্যদের কাছে বিক্রি করলে, আমাদের কাছে বিক্রি করতে সমস্যা কোথায়?
-
আমি তার কোনও যুক্তি বা অনুনয়ের ধার না ধেরে একাই সে বাড়িতে উপস্থিত হলাম। সাথে আসা সেনাদেরকে অন্যদিকে পাঠিয়ে দিলাম। আগাম সংবাদ দেয়া ছাড়া, আচানক ঘরের আঙিনায় হাজির হয়ে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তিনবয়েসী তিনজন মহিলা একমনে কাজ করে চলছে! আমাকে দেখে তারা এতবেশি অবাক-বিহবল হয়ে পড়লো, প্রথমে ঠাহর করে উঠতে পারলো না কী করবে! পরক্ষণেই সাথে সাথে ওড়না দিয়ে ভাল করে মুখ ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকলো! ভাবটা এমন: তিনটা শামুক, বাধা পেয়ে খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে!
তাদের এই অবস্থা দেখে আমার মনে কী যে হয়ে গেলো, আজও এর রহস্য বের করতে পারিনি! শুধু মনে হয়েছে: আমার এখানে আসা ঠিক হয়নি! আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুরুচির পরিচায়ক নয়। দুঃখিত বলে বেরিয়ে এলাম। সরাসরি ক্যাম্পে চলে এলাম। মাথায় তখন তিনজন অসহায় নারীর করুন চাহনি ঘুরছে! যেন মিনতি করছে: আমাদের দ্বারা আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। আমরা দুর্বল! শুধু তরুনির দৃষ্টিতেই শেষের দিকে একধরনের রাগ ফুটে উঠেই মিলিয়ে যেতে দেখেছি! এতসব ঘটে গেছে কয়েক মুহূর্তে!
-
ইনফর্মারকে একান্তে ডেকে পাঠালাম। আমার মন অবিশ্বাস্যভাবে ও-বাড়ির সাথে লেগে আছে। খবর পেয়েই সে ছুটে এল:
-তুমি ওই পরিবার সম্পর্কে কী জানো বলো তো!
-যা জানি সে তো সকালেই বলেছি! স্যার!
-আমি ওদের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই! ব্যবস্থা করতে পারবে!
-জ্বি! পারবো! কিন্তু কেন স্যার! ওরা বলেছে একান্তই না মানলে, তারা গালিচা বিক্রি করে দিবে!
-না না, গালিচা নয়, আমি ওদের কাছে একটু দুঃখ প্রকাশ করতে চাই!
-কী বলছেন স্যার! আপনি ক’জন অসহায় মহিলার কাছে দুঃখ প্রকাশ করবেন? আপনি তো কোনও অন্যায় করেননি! অন্যবাড়িতেও এভাবে যান!
-তা হোক, তুমি আগামীকাল তাদের কাছ থেকে একটা সময় ঠিক করে নিও!
-
পরদিন তরুন ল্যাফটেনেন্ট যথাসময়ে হাজির হলেন। তাকে জানানো হলো: মহিলারা আত্মীয় ছাড়া আর কারো সামনে আসেন না। আড়াল থেকেই ক্ষমাপর্ব সমাপ্ত হলো। বারবার রীতিতে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হলো। প্রতিবেশি ছোট মেয়েরা এটাসেটা এনে দিল। বিদায়ের সময় ইনফর্মার একটা সুন্দর থলে ল্যাফটেনেন্টের হাতে তুলে দিল:
-কী আছে এতে!
-একটা গালিচা স্যার!
-কতো দিতে হবে এটার জন্যে?
-কিছুই দিতে হবে না, আপনার ভদ্রতায় তারা খুবই খুশি হয়েছেন! আর বারবার রীতিতে বাড়িতে মেহমান এলে কিছু একটা উপহার দিতে হয়, তাদের ঘরে দেয়ার মতো কিছুই নেই। আপনারা এখানে আসার পর, এ-বাড়ির কর্তা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন! তারা এখন কোনও রকমে দিন গুজরান করছে!
-নাহ, আমি এমনি এমনি গালিচা গ্রহণ করবো না! কিছু একটা বিনিময় গ্রহণ করতে হবে!
-দুঃখিত স্যার! তাহলে মেজবানকে অপমান করা হবে! তারা দিলে চোট পাবেন!
-
আলিভিয়া! তুই বিশ্বাস করবি না, ক্যাম্পে এসে ব্যাগ খুলে দেখি: এক অপুর্ব গালিচা! কী নকশা! কী কারুকাজ! কী নৈপুণ্য! কী নিখুঁত কাজ! এসব গালিচা বাজারে বিক্রি হয় না। বাজারেরগুলোর কাজ এত নিখুঁত আর সমৃণ হয় না। অনেকদিন ধরে গালিচার কারবার করতে করতে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে!
-আব্বু! তোমার লকারে কি সেই গালিচাই রেখেছ!
-জ্বি। আরো কিছু অমূল্য জিনিস আছে, খুললেই দেখতে পাবি!
-
প্রথম সাক্ষাতেই একজন ভিনদেশী শত্রুকে গালিচা উপহার দেয়া কম কথা নয়। একেকটা গালিচা বানাতে মহিলাদের কতো সময় যে লাগে! আমার মনে হলো, তারা এত সুন্দর একটা উপহার দিল, আমাকেও কিছু একটা দিতে হবে! আবার ইনফর্মারের সাহায্য নিলাম, সে জানাল:
-তারা যাতে গালিচা বিক্রি করে ন্যায্য দামটা পায়, সেটা নিশ্চিত করলেই তাদের সবচেয়ে বড় উপকার হবে!
-তা তো করবোই! এ ছাড়া আর কী করা যেতে পারে?
-আচ্ছা আমি জেনে নিয়ে আপনাকে জানাব!
-
তারা কিছুই নিতে রাজী হলো না। কিন্তু আমার মন তা মানবে কেন! আমি একবার মেয়েটার সাথে কথা বলার অনুমতি চাইলাম। বলা হলো: এক প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে কোনও অপরিচিত পুরুষের সামনে যেতে পারে না। ইসলাম এটার অনুমতি দেয় না। ব্যাপার আমার হজম করতে কষ্ট হলো। আফ্রিকা যাওয়ার আগে অবশ্য আমাদেরকে এসব বিষয় বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। তবুও আমরা যেভাবে বেড়ে উঠেছি, তার বিপরীত একটা প্রথা মানতে কষ্ট হয় বৈকি! আমার ধারণা ছিল: আমি একজন অফিসার! তার ওপর বিজয়ী শক্তি! আমি কোনও মেয়েকে ডেটিংয়ের প্রস্তাব দিলে, সানন্দে মেনে নিবে! এখন দেখি ভিন্নচিত্র!
-
তাদের অনাগ্রহে আমার আগ্রহ আরও তুঙ্গে উঠে গেলো। যেভাবেই হোক এই পবিরারের সাথে আমার একটা পরিচয়সূত্র কায়েম করতেই হবে। তখন থেকেই মরক্কো নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ তৈরী হয়।
ইনফর্মারের মাধ্যমে আরও কয়েকবার প্রস্তাব পাঠালাম। আমি দেখা করতে চাই! আমাতে অবাক ও হতাশ করে দিয়ে, প্রতিবারই একই জবাব এল। স্বাভাবিক অবস্থায় অন্য কেউ হলে জোর খাটাত! আমিও হয়তো তাই করতাম! কিন্তু কেন যে মন সায় দিচ্ছিল না, বুঝতে পারিনি! আজো না। আমার মাথায় তখন খুন চেপে গেছে! যে করেই হোক, তার সাথে দেখা করতে হবে। কথা বলতে হবে। এভাবে কেউ কাউকে প্রত্যাখ্যান করে!
-
ইনফর্মারকে বললাম:
-যে করেই হোক আমাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দাও! আমার মান-ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে!
-স্যার আমি চেষ্টা করতে পারি! না হলে আপনি ক্ষমতা দেখিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেন!
-আরে সেটা হলে তো কবেই হাসিল করে ফেলতাম! আমি জোরাজুরি করতে চাই না!
-তাহলে স্যার, ইহজীবনেও সেটা সম্ভব হবে না। কারন বাধাটা মেয়ের পক্ষ থেকে নয়, মেয়ের ধর্মের পক্ষ থেকে। তার ধর্মের দৃষ্টিতে আপনি বেগানা পুরুষ! আপনার সাথে দেখা দেয়া বা কথা বলা তার জন্যে হারাম! তবে এটুকু হয়তো করা যেতে পারে! আপনি তার সাথে আড়াল থেকে কথা বলবেন!
-না, আমি তার সাথে মুখোমুখি হয়ে কথা বলতে চাই!
-এমন হলে একটাই পথ খোলা থাকে!
-কী সেটা বলো! যত টাকা লাগে আমি খরচ করব!
-টাকা নয়, বিয়ে!
-বিয়ে?
-জ্বি স্যার! আপনার সাথে বিয়ে হলে তখন তার সাথে আপনার দেখা হওয়ার সম্ভব!
-তাহলে সেটার ব্যবস্থা করো!
-কিন্তু আপনার সাথে বিয়েও সম্ভব নয়! কারণ আপনি অমুসলিম!
-আচ্ছা! আমি মুসলিম হলেই সমস্যার সমাধান হবে!
-তারপরও সমস্যা থাকবে! তার পরিবার একজন ভিনদেশীর কাছে বিয়ে দেবেন কি না! আপনি আজ আছেন তো কাল নেই! আপনার কাছে বিয়ে দিলো! কিন্তু আপনি তাকে রেখে চলে গেলেন, তখন? অতীতে এমন ঘটনার নজীর আছে!
-আচ্ছা তুমি তাদের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলো! আমিও একটু ভেবে দেখি!
-
-আব্বু তুমি এতকিছু করছো, তোমার সহকর্মীদের কেউ টের পায়নি?
-এতকিছু কোথায়? আমি তো শুধু তার সাথে কথা বলার বা দেখা করার চেষ্টা করছিলাম! এছাড়া সব কাজতো ঠিকঠাক মতো চলছিল! আমরা আমাদের এলাকায় কোনও মিটিং-মিছিল হতে দেইনি! এদিকে গালিচার রপ্তানীর ব্যবসাও বেশ রমরমা! শুধু এই ‘কেসেই’ যা একটু ফেঁসে গিয়েছিলাম! আমার পৌরূষে বেশ ঘা লেগেছিল বলতে পারিস!
-তারপর!
-তারপর আরকি! অনেক ঝুলোঝুলির পর, মেয়ে রাজি হলো! কিন্তু মেয়ে তার বাবার অনুপস্থিতিতে বিয়ে করবে না। মেয়ের বাবা আত্মগোপনে আছে। আবার এদিকে আমার ক্যাম্পেও বিয়েটা গোপন রাখতে হবে! মেয়ের বাবা রাজি হন কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ! তবে আশার কথা, মেয়ের দাদীর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তিনি নিমরাজি!
-
সব কথা বলতে গেলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। সবকিছু গুছিয়ে বিয়ে হলো। বিয়ের আগে আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হলে: শুধু বিয়ের জন্যেই মুসলমান হওয়া ঠিক নয়। আমাকে মনেপ্রাণে মুসলমান হতে হবে। মেনে নিলাম। বহুল কাঙ্খিত প্রথম সাক্ষাত হলো। আমি কল্পনার চেয়েও বেশি অভিভূত হয়ে পড়লাম তাকে দেখে! তার ভদ্রতা সৌজন্যবোধ দেখে। আমার প্রতি ওর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসামাখা আচরণ দেখে। আদর-যত্ন দেখে।
আমি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। কারণ আমি যা করেছি, তার জন্যে আমাকে চর আখ্যা দিয়ে, কোর্ট-মার্শাল হওয়াও বিচিত্র কিছু ছিল না। সবাইকে লুকিয়ে কয়েকমাস আমাদের দেখা-সাক্ষাত চললো। তবুও এসব খবর গোপন থাকে না। আমার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ধরতে না পারলেও আমার গতিবিধিতে সন্দেহজনক কিছু আঁচ করতে পারলেন। আমার কমান্ডিং অফিসার ডেকে নিয়ে সরাসরি সতর্ক করলেন।
-
তবুও ‘ইয়ামনার’ আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার! আমি ফাঁক পেলেই তার কাছে ছুটে যেতাম। এদিকে মরক্কোতে আমাদের অবস্থান দিনদিন নড়বড়ে হয়ে আসছিল! কর্তৃপক্ষের কানে বোধহয় নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনও তথ্য গিয়েছিল। তারা একদিন আমাকে নিয়ে বসলেন। তীব্র জেরার মুখে পড়লাম। বিয়ের কথা না বললেও একপ্রকার সম্পর্কের কথা স্বীকার না করে পারলাম না। পুরোদেশের টালমাটাল পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, আমার বিরুদ্ধে কঠোর কোনও ব্যবস্থা নেয়া হলো না। তবে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ ফাইলবন্দী করা হলো। আমাকে কোনও সুযোগ না দিয়ে, সেই বৈঠক থেকেই আলজেরিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বলে দেয়া হলো:
-যদি কখনো মরক্কোতে আসি এবং এখানকার সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, আমাদের উভয়ের প্রাণসংশয় দেখা দিবে! এটা ফ্রান্সের সম্মান ও নিরাপত্তার স্বার্থেই করতে হবে!
-
আমাকে কড়া নজরদারিতে রাখা হলো। একটি মুসলিম মেয়ের সাথে সম্পর্কের ‘অপরাধে’ ব্যাজ-র্যাংক কেড়ে নেয়া হলেও, বিশেষ বিবেচনায় ফেরত দেয়া হলো। গোপন সূত্রে জানতে পেরেছিলাম: মরক্কোর হাইকমান্ড আরও তদন্ত চালিয়েছিল। তারা সূত্র ধরে ধরে ‘ইয়ামনা’ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তার বাবার সাথে বিদ্রোহীদের সংযোগও আবিষ্কার হয়ে পড়েছিল। এসব ঝামেলার মুখে তারা নিজগ্রাম ত্যাগ করে অজ্ঞাত কোনও নিরাপদ স্থানে সরে পড়তে সক্ষম হয়েছিল। এর বেশি কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি!
-
ফ্রান্সে ফিরে কোনও উপায়ান্তর না দেখে, নিজেকে পরিস্থিতির হাতে ছেড়ে দিলাম। কর্তৃপক্ষের চাপে বিয়েও করতে হলো। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স আমার ব্যাপারটাকে সিরিয়াসভাবে নিয়েছিল। তাদের বজ্রআঁটুনি ফস্কে নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ ছিল না। আমি দেখলাম বিয়ে করাই সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত। আমাদের উভয়ের জন্যে নিরাপদ। সময়ের সাথে সাথে দগদগে ঘা শুকিয়ে এলো। তবে একেবারে মুঝে গেলো না। আমাকে দেয়া ইয়ামনার গালিচা ও কয়েকটা অপূর্ব হাতের কাজ করা শোপিস আমার কাছেই রয়ে গেলো। স্বপ্নময় অতীতের একচিলতে স্মৃতি হিশেবে!
-আব্বু! তার কথা তোমার মনে পড়তো না!
-অবশ্যই পড়তো। কিন্তু কাউকে বলার উপায় ছিল না। তাই বলে মার্থাকে আমি বিন্দুমাত্র অবহেলা করিনি। তাকে আমি শতভাগ স্ত্রীর মর্যাদায় রাখার চেষ্টায় কোনও কমতি করিনি। আর তোর মাও ছিলো এক অসাধারণ মানুষ! তার গভীর অনুরাগ আমাকে সাময়িকভাবে পেছনের কথা ভুলে থাকতে সহযোগিতা করেছে, এটা অস্বীকার করবো না! কিন্তু প্রথম ভালোলাগাকে তো ভোলা অসম্ভব! আর সে আমার বিয়ে করা বৈধ স্ত্রী! পবিত্র। কোমল। গভীর। দৃঢ়চেতা। সাহসী। দায়িত্বশীল। কর্মঠ। গুণী।
-
-এখন কী করবে?
-করার মতো অনেক কিছুই আছে! কিছুদিন আগে আমি গোয়েন্দাদের লুকিয়ে, প্যারিসের এক মসজিদে গিয়েছিলাম।
-কেন?
-কনফেশন করতে!
-তারা জানাল, ইসলাম ধর্মে মানুষের কাছে কনফেশন করার নিয়ম নেই, যা কিছু সরাসরি গডের কাছেই করতে হয়। খ্রিস্টানদের মতো ভায়া লাগে না। তবুও স্বস্তি পেলাম না। খালি মনে হতে লাগলো, আমি ‘ইয়ামনার’ সাথে প্রতারণা করেছি। কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, আমি শুধু তার নিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করিনি! আমি তার খোঁজ পেয়ে গেলে, ট্রেইল ধরে ধরে গোয়েন্দারাও যদি তাকে ট্রেস করে ফেলে?
অলিভিয়া! ইমাম সাহেবের একটা কথা আমার কানে বেশ বাজে ! তিনি পুরো ঘটনা শুনে বলেছিলেন:
-আপনি তো তাহলে একজন মুসলিম!
-কিন্তু আমি তো সামাজিক পরিচয়ে একজন খ্রিস্টান! আমার দ্বিতীয় বিয়েও খ্রিস্টরীতিতে হয়েছে। কারণে-অকারণে চার্চেও যেতে হয়েছে! তাছাড়া ইসলাম সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যা কিছু জেনেছিলাম, তার সব ভুলে গেছি!
-তা হোক! আপনি একজন মুসলিম! আপনি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসুন!
-তার আগে আমি একটা কাজ করতে চাই, আমার পূর্বের স্ত্রীর হদিস বের করতে চাই! তারপর আমি বিষয়টা নিয়ে ভাববো!
-মশিয়ে ফিলিপ! আপনি চাইলে উল্টো করেও দেখতে পারেন!
-কিরকম?
-আপনি ইসলাম ধর্ম পালন শুরু করে দিন! আল্লাহ তাহলে আপনার কাজকে সহজ করে দিবেন!
-আচ্ছা ভেবে দেখি!
.
-তুমি একজন লোক খুঁজছিলে, সেটা তাহলে মরক্কো-বিষয়ক গবেষণার জন্যে ছিল না!
-গবেষণাও উদ্দেশ্য ছিল, পাশাপাশি তাকে দিয়ে একটু খোঁজ-খবর করার অভিপ্রায়ও ছিল!
-অমন কাউকে পেয়েছ?
-না।
-আব্বু! এক কাজ করলে কেমন হয়! আমিই না হয় মরক্কো চলে যাই! একটু খোঁজ-খবর করে আসি!
-সত্যি বলছিস! তোর যদি আগ্রহ থাকে, তাহলে এটাই সবদিক থেকে নিরাপদ!
-
অলিভিয়া তার অফিস থেকে লম্বা একটা ছুটি নিল। রাবাতে নেমে সরাসরি ফেজ নগরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। ফেজে পৌঁছে, আব্বুর দেয়া স্মৃতিনির্ভর ঠিকানা অনুসারে খোঁজ করা শুরু করলো: গ্রামের নাম কীকু! এটাই সম্বল। কয়েকদিনের চেষ্টা-কসরতে কীকুনামী কয়েকটা গ্রাম চিহ্নিত করা সম্ভব হলো। এবার ঝাড়াই-মাড়াইয়ের পালা। প্রতিদিন লং ডিসটেন্স কলে, বাবার সাথে কথা হয়। তিনিও তার নিজস্ব সোর্স কাজে লাগিয়ে, সে সময়কার ক্যাম্পের জায়গাটা সুনির্দিষ্টভাবে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
-
বাপ-বেটির যৌথ প্রয়াসে ঠিক গ্রামটা বের হলো। এবার সরেজমীনে গিয়ে অনুসন্ধানের পালা। অনেক বড় গ্রাম! একজন স্থানীয় গাইডের সাহায্যে গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে কথা বলে জানা গেল: এই গ্রামের অদূর একটা অস্থায়ী সেনাছাউনি ছিলো। গ্রামের বাজারের পুরনো গালিচা-ব্যবসায়ীরাও আবছা আবছা স্মৃতিমন্থন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু কাঙ্খিত সূত্র পাওয়া গেলো না। হঠাৎ মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো: গ্রামের বয়স্কা কোনও মহিলার কাছে খোঁজ নিলে হয়তো একটা বিহিত হতে পারে! কয়েকজনের সাথে কথা বলেও কিছু বের হলো না। একবুড়িমা শুধু বলতে পারলো: নাম ইয়ামনা কি না বলতে পারবো না! তবে অনেক আগে এই গ্রামের একটা পরিবার উত্তর দিকের একটা গ্রামে গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করেছে, সেটা মনে আছে। গ্রামের নাম ‘আয়াত হামযা’।
-
আবার নতুন করে পথচলা শুরু হলো। একে তো ভিনদেশী, তায় ভিনভাষী। তবে ভাগ্য বলতে হবে, বয়স্করা কিছু কিছু ফরাসী বোঝে! গ্রামটা বেশ সুন্দর আর ছিমছাম। গাইড প্রথমেই একটা স্কুলঘরের মতো লম্ব এক ভবনে নিয়ে গেলো। সেটা মূলত ক্ষুদ্রকুটিরশিল্পচর্চাকেন্দ্র। অসংখ্য মহিলা সারিবদ্ধভাবে বসে-দাঁড়িয়ে গালিচা বুনছে! একদল ভেড়ার পশম কাটছে। আরেক দল পশমকে বিশেষ চিরুনির সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করছে। অসংখ্য কাজের ধরন। অলিভিয়ার মনে হলো, কে তার লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অফিসে গেলো। সেখানে এক যুবক বসে বসে ফাইল দেখছে। অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসলো:
-আমি একজন মানুষের খোঁজে এসেছি! একজন মহিলা! নাম ইয়ামনা।
-আচ্ছা! আপনি কোত্থেকে এসেছেন?
-ফ্রান্স থেকে! ইয়ামনা নামে কাউকে চেনেন?
-জ্বি, চিনি! তার কাছে আপনার কী প্রয়োজন? তার নামই বা জানলেন কী করে? (যুবকের চেহারায় ভীষণ বিস্ময়!)
অলিভিয়া ব্যাগ্রস্বরে জানতে চাইল:
-সত্যি সত্যি তাকে চেনেন! আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন!
-
অলিভিয়ার বিশ্বাস হচ্ছিল না এত সহজেই মিলে যাবে। যুবক তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। ঘরে প্রবেশ করে ছেলেটা জোরে আম্মু বলে ডাক দিল। অলিভিয়ার মনে ভাবান্তর সৃষ্টি হলো, তবে কি এই যুবক তার সন্তান? তার আবার বিয়ে হয়েছিল! এসব ভাবনার মাঝেই একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এলেন। দেখে অজান্তেই অলিভিয়া দাঁড়িয়ে গেলো। তার দু’চোখ নির্ণিমেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, মধ্যময়েসেও মানুষ এত সুন্দর হয়! ইনিই কি তিনি?
-আমি অলিভিয়া! ফ্রান্স থেকে এসেছি!
-আমি বুঝতে পেরেছি! আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, তোমাকে কেউ একজন পাঠিয়েছে, ঠিক আছে না?
-কিভাবে বুঝলেন?
-ওইযে বললাম অনুমান! ঠিক কি না বলো!
-একদম ঠিক! আমার আব্বু পাঠিয়েছেন।
মহিলা এবার এসে গভীর আবেগে অলিভিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকক্ষণ ধরে থাকলেন। ঝাপসা চোখে অলিভিয়াকে পরম আদরে চুমু দিলেন। প্রায় কোলে করে নিয়ে সোপায় বসালেন। তারপর শুরু হলো কথাবার্তা। অলিভিয়া সবকিছু খুলে বললো বাবার অসহায়ত্বের কথা, সরকারী গোয়েন্দাদের নজরদারির কথা!
-আমি তো সব বললাম, আমি এসেছি আপনাকে দেখতে। আপনার কথা শুনতে!
-আমার কথা আর কী শুনবে! বলার মতো তেমন কিছুই নেই!
-তবুও শুনবো! বলূন!
-এখন থাক! তুমি এতদূর থেকে এসেছ! বিশ্রাম করো। খাওয়া-দাওয়া করো! রাতে বসবো! আর হাঁ, ও তোমার ভাই! মা ভিন্ন হলেও বাবা এক!
-তাই!
অলিভিয়া বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়বো। দু’চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। সে উপলব্ধি করতে পারলো, আব্বু যেভাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিলেন, সেটা বাস্তবিকই যথার্থ ছিল না। তিনি আরও অনেক বেশি মহিয়সী!
-
রাতে খাবার শেষে ছোট্ট মেয়ের মতো আদর করে নিজের খাটে নিয়ে বসালেন। ইয়ামনা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। ফরাসি ভাষাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু হৃদয় যেখানে দ্বার খুলে দেয়, ভাষা সেখানে কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারে না।
-আপনার কথা বলুন! একটুও বাদ দেয়া যাবে না!
-আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ইয়ামীন মানে তোমার বাবা কোনও কাজে ব্যস্ত আছে। মুসলমান হওয়ার পর আব্বু আমার নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রেখেছিল ইয়ামীন! তাকে না আসতে দেখে, আমরা কিছু মনে করলাম না। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছিল। আমাদের সম্বিত ফিরল পরপর কয়েকদিন অন্য সেনা কর্মকর্তা গ্রামের টহলে আসতে দেখার পর! খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ইয়ামীনকে কর্তৃপক্ষ জরুরীভিত্তিতে পাঠিয়ে দিয়েছে!
তারপরও মনে মনে আশা ছিল, সবকিছু গুছিয়ে যোগাযোগ করবে। সেই আশাতেই জীবন কেটে গেলো। সে চলে গেলো, এদিকে আমাদের ওপর নিত্য নতুন হয়রানি শুরু হলো। অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে দেখে, আমরা রাতের আঁধারে গ্রামত্যাগ করি! বিভিন্ন স্থান ঘুরে, এই গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
আব্বু-আম্মু-দাদু মিলে বহুচেষ্টা করেছিলেন আমার বিয়ে দেয়ার। ভাল ভাল সম্বন্ধও এসেছিল! কিন্তু একেতো আমি সন্তানসম্ভবা অন্যদিকে সবসময় মনে হতো: এই বুঝি ও এলো! কারণ ভিনদেশী হলেও আমাদের তিনমাসের সংক্ষিপ্ত সংসারজীবনে তাকে যেভাবে চিনেছি, আর যাই হোক, তাকে প্রতারক মনে হয়নি! আমার মন বলতো, সে নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছে! ওটা কেটে গেলে ঠিকই ছুটে আসবে!
-
সন্তানের জন্ম হলো। তাকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটলো। ও একটু বড় হওয়ার পর আবার কিছু সময়ের জন্যে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম। তখন দেশ নতুন স্বাধীন হয়েছে! অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয়! মনের মধ্যে একটা খেয়াল এলো:
-গ্রামের মহিলাদেরকে একসাথ করে, কিছু করা যায় কি না? ভাবতে ভাবতে বের হলো, তারা তো সবাই গালিচা বানাতে পারে! এটাকেই কিভাবে আরও গতিশীল ও লাভজনক করা যায়? একা একা গালিচা বুনতে গেলে অনেক সময় লেগে যায়! কিন্তু কয়েকজন মিলে করলে, অতিদ্রুত কাজ তুলে ফেলা যায়! তাই প্রথম দিকে তিনজনের একটা দল গঠন করে, যৌথভাবে কাজ শুরু করলাম। আস্তে আস্তে দল ভারী হতে হতে, গ্রামের সবাই এখন আমাদের এই ভবনে কাজ করে। সবাইকে তার কাজের ধরন অনুযায়ী মুনাফা দেয়া হয়।
-
হিশেব রাখা হয়, কে কতটুকু কাজ করেছে! ফাঁকি দেয়ার অবকাশ কম! তাদের মেহনতও কমে এসেছে বহুগুণ, আবার আয়-রোজগারও বেড়েছে !
-আচ্ছা আম্মু! এই যে দীর্ঘ একটা সময় একা একা কাটিয়ে দিলেন, খারাপ লাগেনি?
-একদম লাগেনি তা নয়, কিন্তু নিজেকে সব সময় কোনও না কোনও কাজে জড়িয়ে রেখেছি! খুব বেশি ভাবার ফুরসৎ মেলেনি! স্কুলে সময় দিয়েছি! মেয়েদেরকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছি! হাতের কাজ শিখিয়েছি! এই করেই জীবনটা কিভাবে যেন পার হয়ে গেছে প্রায়!
-আম্মু! আসল প্রশ্নটা করি! আব্বু যদি আপনার সাথে দেখা করতে আসতে চায়, আপনার আপত্তি নেই তো!
-আমার সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়নি! আমি তার স্ত্রী। ও আমার স্বামী! তাকদীর আমাদেরকে একটা পরীক্ষায় ফেলেছিল! এখন হয়তো জোড়া লাগাতে চাইছে! আমি এমনটাই ভাবি। এতদিন এটা ভেবেই মনকে প্রবোধ দিয়ে এসেছি। আর সত্যি বলতে কি, আমি তার প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতেই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। তাকে পেয়ে আবার হারাতে চাইবো কেন? আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। সে যেমনই হোক! শুধু মুসলমান হলেই হবে।
-আব্বু চাকুরিতে থাকাবস্থায়, তার ওপর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন সেটা নেই। তবুও কিছু আইনি বাধা ছিল, এতদিনে সেটা কেটে গেছে আশা করি! এখানে টেলিফোন না থাকাতে এতবড় একটা সুসংবাদ তাকে দিতে পারছি না! আগামী কাল তার সাথে কথা বলবো! আপনি কি আমার সাথে যাবেন?
-না মা, তার সাথে আমার দেখা ও কথাটা সরাসরি হোক! আগে কথা বলে এতদিনের জমিয়ে রাখা আবেগ-অনুরাগ হালকা করতে চাই না!