একজন বুড়ো আলেম ছিলেন। এক মহল্লার মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করতেন। নামায ও কুরআন তালীমের পিছনেই জীবনের সময় ব্যয় করেছিলেন তিনি। একদিন তিনি অনুভব করলেন, দিনদিন নামাযীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিষয়টি তাঁকে পেরেশান করছিল। মুসল্লীদেরকে তিনি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। একদিন নামায শেষে মুসল্লীদের দিকে ফিরে বললেন, ব্যাপার কী, মানুষ নামাযে আসে না যে? বিশেষত মসজিদে যুবকদের দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না।
মুসল্লীরা বললেন, লোকজন রং-তামাশা ও উম্মাদনায় ব্যস্ত। নাচঘরে গিয়ে সবাই নাচ দেখছে। ইমাম সাহেব বললেন, নাচঘর! তা আবার কী জিনিস?
এক যুবক মুসল্লী বললেন, অনেক বড় একটি কামরা। তার একপাশে কাঠের তৈরী লম্বা-চওড়া মঞ্চ। তাতে তরুণীরা খুব সংক্ষিপ্ত কাপড়চোপড় পরে কুদাকুদি করে; বেসামাল হয়ে নাচে। লোকজন তাদের সামনে বসে তৃষ্ণকাতর দৃষ্টিতে সেই নাচ দেখে, তালি বাজায় এবং নর্তকীদের ভূয়ষী প্রশংসা করে।
বুযুর্গ ইমাম বললেন, নাউযু বিল্লাহ! আচ্ছা, এই নর্তকীদের নাচ যারা দেখে, তারা কি মুসলমান?
বৃদ্ধ ইমাম অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ন হয়ে বললেন, ‘লা হাওলা, ওয়া লা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। এ তো মারাত্মক ঘৃণ্য পরিস্থিতি। আমাদের কর্তব্য এসব লোককে হেকমতের সাথে নসীহত করা এবং সিরাতে মুস্তাকীমে তোলার জন্য চেষ্টা করা।
ইমামের কথা শুনে মুসল্লীরা হয়রান হয়ে গেলেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি নাচঘরে গিয়ে লোকজনকে নসীহত করবেন?
বৃদ্ধ ইমাম ‘হাঁ, করব’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, আপনারা চলুন আমার সাথে। আমরা নচঘরে যাব।
মুসল্লীরা তাঁকে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। তারা বললেন, জনাব! আপনি নাচঘরে যাবেন না। ওটা হচ্ছে পাপের কারখানা। ওখানে যারা থাকে, তারা মানুষ নয়; হিংস্র প্রাণী; শয়তানের চেলা। বদতমীযরা আপনাকে নিয়ে হাসি-মজাক করবে; ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে। আপনাকে বিভিন্ন প্রকারে কষ্ট দিবে। নানা ধরণের মন্তব্য করবে। গালাগালির তীর নিক্ষেপ করবে। আপনি ওদের হাসির পাত্রে পরিণত হবেন।
বুড়ো ইমাম ভারী গলায় বললেন, প্রিয় মুসল্লী ভাইয়েরা! চিন্তা করে বলুন তো, আমরা কি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। তিনি কি হকের দাওয়াত দিতে গিয়ে পরীক্ষায় পড়েননি? তাঁকে নিয়ে মজাক করা হয়নি? তাঁকে কি যাদুগর ও পাগল বলা হয়নি? কী বলেন, তাঁর রাস্তায় কি কাঁটা বিছানো হয়নি? জুলুম-অত্যাচারের এমন কোন পদ্ধতি আছে, যা মানবকুলের এই সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তার উপর প্রয়োগ করা হয়নি? এরপর আমি আপনি কি?
ইমাম সাহেব এক মুসল্লীর হাত ধরে বললেন, নাচঘরে কোন দিকে, আমাকে দেখিয়ে দিন। একথা বলে তিনি অত্যন্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে রওয়ানা হলেন। দুই-একজন মুসল্লী তাঁর সঙ্গী হলেন।
নাচঘরের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলেন তাঁরা। নাচঘরের মালিক দূর থেকেই তাদেরকে দেখে ফেলল। সে ভাবছিল, হয়তো ইমাম সাহেব কোন ওয়াজ-মাহফিলে যাবেন। কিন্তু ইমাম সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে সোজা তার কাছে এসে উপস্থিত হলেন।
নাচঘরের মালিক তাজ্জব হয়ে গেল। বলল, আপনারা কী চান, বলুন তো!
ইমাম সাহেব বললেন, ‘নাচঘরে উপস্থিত লোকদেরকে ওয়াজ করতে চাই।’ একথা শুনে হলমালিকের বিস্ময়ের সীমা থাকল না। ইমামের আবেদন রক্ষার অপারগতা প্রকাশ করল সে। বৃদ্ধ ইমাম খুব নরম ভাষায় তার সাথে কথা বললেন। আখেরাতে বড় প্রতিদান লাভের সুসংবাদ দিলেন। কিন্তু সে পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করল। তখন ইমাম সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি, আপনার ব্যবসায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে বলে, আপনি রাজি হচ্ছেন না। আচ্ছা, আমরা আপনাকে একদিনের পুরো অর্থ পরিশোধ করে দিচ্ছি।
এরপর ইমাম সাহেব একদিনের আয় হিসেব করে হলমালিককে দিয়ে দিলেন। তখন মালিক বলল, আচ্ছা, আগামী কাল প্রদর্শনী শুরু হলে আসবেন।
পরের দিন যথাসময়ে প্রদর্শনী শুরু হল। লোকজন পূর্ণ মনোযোগের সাথে নাচ দেখায় মত্ত। থিয়েটারের মঞ্চ থেকে শয়তানের আওয়াজ ভেসে আসছিল। সমস্ত দর্শকের দিল ছিল তখন শয়তানের হাতে। লোকজন তালি বাজাচ্ছিল। এমন সময় একবার পর্দা পড়ে গেল। আবার যখন পর্দা উঠল, তখন দর্শকরা সব হতভম্ব। বৃদ্ধ ইমাম গাম্ভীর্যের সাথে একটি চেয়ারে উপবিষ্ট। তিনি বিসমিল্লাহ পড়লেন। আল্লাহ তাআলার হামদ-সানা বয়ান করলেন।
এরপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় সত্তার উদ্দেশ্যে দরুদ পড়ে ওয়াজ শুরু করলেন। দর্শকরা সব হাক্কাবাক্কা হয়ে গেল। একজন আরেক জনের দিকে দেখতে লাগল তারা। কেউ কেউ হাসিমজাক শুরু করে দিল। কিন্তু বৃদ্ধ ইমাম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। ওয়াজের ধারা অব্যাহত রাখলেন তিনি। অবশেষে দর্শকদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বললেন, প্রিয় দর্শকমণ্ডলি! একটু নীরব হোন। দেখুন, ইমাম সাহেব কী বলতে চান।
তার এই কথায় পুরো হলে নীরবতা ছেয়ে গেল। দর্শকদের অন্তরে সকীনা নাযিল হতে থাকল। থেমে গেল হাসিমজাকের আওয়াজ। চারদিক ভেসে আসতে লাগল ইমাম সাহেবের আওয়াজ। তিনি খোদাভীতির এমনসব আয়াত তেলাওয়াত করতে লাগলেন, যেগুলো পাহাড়ে কম্পন সৃষ্টি করতে পারে। এরপর তিনি মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণকামী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু হাদীস উল্লেখ করলেন। ঈমান ও আমালে সালেহ’র বরকত ও প্রতিদান তুলে ধরলেন। নেককারদের উচ্চ মর্যাদার বিবরণ দিলেন। আল্লাহর না-ফরমান, শয়তান ও বদকারদের ভয়ানক পরিণতির চিত্র আঁকলেন।
শিক্ষাপ্রদ অনেক কাহিনী উল্লেখ করে তিনি বললেন, আমার ভাইয়েরা! তোমরা অনেক দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেছ। মেহেরবান মাওলার অনেক না-ফরমানী করেছ। খাব ও গাফলতে বহু সময় চলে গেছে। এখন একটু ভাবো। নিজের অবস্থার উপর চিন্তা করো। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একটু বলো, আল্লাহর না-ফরমানী করে তোমরা কী পেয়েছ? তোমাদের গুনাহ তোমাদের আমলনামায় লেখা হয়েছে। এখন তোমাদের গুনাহের মজা কোথায়? নিঃসন্দেহে মজা শেষ হয়ে গেছে; অথচ তোমাদের অপকর্মের ফল রয়ে গেছে। অতিসত্বর তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে। সেই সময় খুবই কাছে, যখন সবকিছু ফানা হয়ে যাবে। সূর্যের আলো থাকবে না। চাঁদ-তারা উদয়-অস্তের কাহিনী থামিয়ে দিবে। বাদল হারিয়ে যাবে। ছেয়ে যাবে অন্ধকার। শুরু হবে ঘুর্ণিঝড়। জমীন কাঁপতে কাঁপতে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পাহাড়-পর্বত তুলার আঁশের মত উড়তে থাকবে। দরিয়ার মৌজ, শয়তানের ফৌজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। স্রোতের পানি রাস্তা ভুলে যাবে। রুক্ষ হয়ে যাবে বসন্ত। ফুল আর ফুটবে না। চারদিকে শুরু হবে মৃত্যুর নাচন। জীবনের একটি শ্বাসও অবশিষ্ট থাকবে না। শুরু ওয়াহেদ ও কাহ্হার আল্লাহ থাকবেন। নিজের হাতটা একটু বুকের উপর রাখো। কখনও নিজের অন্তরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখেছ? নিজের আমলের খবর নিয়েছ। তোমাদের কি মনে আছে, অতিসত্বর তোমরা কোথায় যাবে? তোমরা দুনিয়ার আগুন বরদাশত করতে পার না। অথচ জাহান্নামের আগুন এর চেয়েও সত্তর গুণ অধিক শক্তিশালী। জাহান্নামের অগ্নিশিখাকে ভয় করো। সময় নষ্ট করো না। ওঠো! তওবা করো। অনুতাপের অশ্রু প্রবাহিত করো। রুষ্ঠ রবকে সন্তুষ্ট করো। আহ! তোমরা প্রভুর সামনে কোন মুখ নিয়ে উঠবে। কখনও কি চিন্তা করেছ, আল্লাহ তাআলার কত এহসান রয়েছে তোমাদের উপর?
তাঁর রহমত কি তোমাদের উপর হারদম নাযিল হয় না এবং তোমাদের গুনাহের বোঝা কি তাঁর কাছে উপস্থিত হয় না? তিনি তোমাদেরকে হাজারও নেয়ামত দিতে থাকেন, আর তোমরা প্রতি মুহূর্তে তাঁর না-ফরমানীতে ডুবে থাক। নিজের সীমালঙ্ঘন দেখো, তাঁর অনুকম্পাও দেখো! বৃদ্ধ ইমাম দিলের গভীর থেকে কথা বলছিলেন। তাঁর ওয়াজ হৃদয়ে ঝঙ্কার সৃষ্টি করছিল। প্রতিটি বাক্য তীর হয়ে দর্শকের বুকে গাঁথছিল। তাদের দিলের কায়া বদলে গেল। জীবনের মূল হাকীকত সূর্যের মত স্পষ্ট হয়ে গেল। লোকজন কাঁদতে লাগল। অনেকের হেচকি শুরু হল।
ইমাম সাহেব তাদেরকে তাসাল্লী দিলেন। বললেন, বন্ধুরা! দিলের ভিতরে পরিবর্তন সৃষ্টি করো। তওবা করো। গুনাহ থেকে পলায়ন করো। মৌসুম যেমন বদলায়, ঠিক সেভাবে বদলে যাও। আমাদের রব মহানুভব, উদার ও অত্যন্ত দয়ালু। বন্ধুরা! রব্বে করীমের উপর ভরসা করো। দেখতে পাবে, করুণাময় স্রষ্টা খুব দ্রুত তোমার উপর সন্তুষ্ট হবেন এবং তোমার মাথায় ইযযত ও অনুগ্রহের তাজ বসিয়ে দিবেন।
সবশেষে ইমাম সাহেব দোআ করলেন, হে রব্বে যুল-জালাল! আমরা তোমার আলীশান দরবারের ভিক্ষুক। যে তোমার উঠানে আসে, সে নিরাশ ফিরে যায় না। আমরা ভিক্ষার হাত তোমার সামনে প্রসারিত করেছি। তুমি অসীম দয়ালু। তোমার অনুগ্রহের ভাণ্ডার অফুরন্ত। মাফ করে দেওয়া তোমার মহান বৈশিষ্ট্য। তওবাকারী ও ক্ষমাপ্রার্থীদেরকে তুমি খুব পছন্দ কর। আমরা গুনাহগার বান্দা তোমার কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইছি। আমাদের গুনাহ মাফ করে দাও। আমাদেরকে বদ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে দাও। আমাদেরকে নেকীর জীবন দান করো।
ইমাম সাহেব যখন এভাবে দোআ করছিলেন, তখন পাপ-পঙ্কিলতার আখড়া নাচঘরে ‘আমীন’ ‘আমীন’ ‘আমীন’ পবিত্র ধ্বনীতে গুঞ্জরিত হচ্ছিল। ইমাম সাহেব অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। নাচঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলে মসজিদের দিকে। তাঁর পিছনে পিছনে বের হলো নাচঘরের সমস্ত দর্শক। সবাই এই মহান ইমামের হাতে তওবা করল। তারা বুঝতে পারল, জীবনের গুরুত্ব। আরও বুঝতে পারল, এই নাচগান, রং-তামাশা কোন কাজে আসবে না, যখন হাতে হাতে আমলনামা দেওয়া হবে এবং পাপগুলো বিশাল আকার ধারণ করবে।
দর্শকদের সাথে তওবা করল নাচঘরের মালিকও। তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন