ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
যারা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নৈকট্য হাসিল করতে চায়, তাদের কাছে পবিত্র মাহে রমজান পরম আনন্দের। স্বয়ং আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই রজবের শুরু থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন, কবে আসবে কাক্সিক্ষত রমজানুল মুবারক। মাহে রমজান বড়ই বরকতময়। এ মাসে একটি নফল আদায় করলে অন্য মাসের একটি ফরজের সমান সওয়াব পাওয়া যায়, আর একটি ফরজ আদায় করলে পাওয়া যায় অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াব। কী বিশাল সুবর্ণ সুযোগ! সঙ্গতকারণে যারা কল্যাণকামী - বাগিউল খায়র- তারা ইবাদতের সকল ময়দানে পদচারণার চেষ্টা করেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রহমত-বরকত কুড়োতে ছুটোছুটি করেন। নামাজ, রোজা, কুরআন তেলাওয়াত, জিকর-দোয়া, এতেকাফ, উমরা এবং জাকাত ও অন্যান্য দানসহ যাবতীয় ইবাদতে নিজেকে মনোনিবেশ করেন।
জাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। নামাজ রোজার মতো এটাও ফরজ। পবিত্র কুরআন শরীফে বহু স্থানে নামাজ আদায়ের নির্দেশের পাশাপাশি জাকাত প্রদানেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জাকাত বছরের যেকোনো সময় ফরজ হতে পারে। আদায়ও করা যায় যেকোনো সময়। তবে যেহেতু পবিত্র রমজান মাসে একটি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াব পাওয়া যায়, তাই বেশী সওয়াবের আশায় রমজান মাসে ব্যাপকভাবে জাকাত আদায় করা হয়ে থাকে।
আমাদের সমাজে তিন শ্রেণির মুসলমানের দেখা পাওয়া যায়। এক শ্রেণি সকল জাকাতযোগ্য সম্পদের সঠিক হিসেব কষে পুরোপুরি জাকাত আদায় করেন। জাকাতযোগ্য কোনো সম্পদই জাকাতের বাইরে রেখে সম্পদকে ‘নোংরা’ করে রাখেন না। আরেক শ্রেণি মোটেও জাকাত দেন না। আর আরেকটি শ্রেণির মুসলমান আছেন, যারা জাকাত আদায় করেন বটে, তবে কিছু সম্পদের মালিকানা নিয়ে তাদের সংশয় বা টালবাহানা থাকে। ওই সম্পদের জাকাত কে আদায় করবেন, তা নিয়ে বেশ ঠেলাঠেলি চলে। এর ফলে ওই সম্পদের জাকাত অনাদায় থেকে যায়। এমনই ঠেলাঠেলির সম্পদ হচ্ছে গয়না।
অনেক পুরুষকে প্রশ্ন করতে দেখা যায়, বাড়িতে যে গয়না আছে, তা আমার স্ত্রীর। ওগুলো ওর, ওই ব্যবহার করে। ওগুলোর জাকাত দেবে কে? পুরুষটি যখন বলেন, ‘তা আমার স্ত্রীর’, তখন তার কথার ধরনে উত্তর দেওয়া হয়, ওই গয়নার জাকাত দেবেন স্ত্রী। পুরুষ তখন যেন তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। যাক বাঁচা গেল। দায়-দায়িত্ব এবার সব স্ত্রীর ঘাড়ে। গয়না গয়না করে জান দাও, এবার তবে জাকাত দাও।
এক্ষেত্রে অনেক মহিলাকে বলতে শোনা যায়, আমি কি ইনকাম করি নাকি যে, আমি জাকাত দেব? আমার তো কোনো টাকা-পয়সা নেই, জাকাত দেব কোত্থেকে?
কোনো মহিলার যদি নেসাব পরিমাণ সোনার গয়না (সাড়ে সাত ভরি) বা রূপার গয়না (সাড়ে বায়ান্ন ভরি) থাকে এবং তা একবছর সময়কাল অতিক্রম করে, তাহলে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে। উল্লেখ্য যদি সোনা ও রূপা উভয়ের গয়না থাকে এবং এককভাবে কোনোটাই নেসাব পরিমাণ না হয়, তাহলে উভয়ের বিক্রয়মূল্য ধরে তাকে টাকায় রূপান্তর করতে হবে। সোনা ও রূপার নেসাবের মধ্যে যার মূল্য কম, ওই টাকা যদি সেই নেসাব পরিমাণ হয়, তাহলেই জাকাত ফরজ হয়ে যাবে। যেমন কারো মালিকানায় ৩ ভরি সোনার গয়না এবং ১০ ভরি রূপার গয়না আছে। এখানে এককভাবে কোনোটাই নেসাব পরিমাণ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে উভয়টাকে বিক্রয়মূল্য ধরে টাকায় রূপান্তর করতে হবে। উভয়টার বর্তমান আনুমানিক বিক্রয় মূল্য (জাকাতের হিসেব বের করার সময় বর্তমান বাজার যাচাই করে নিতে হবে) সোনা = ৩ দ্ধ ৩২,০০০ = ৯৬,০০০/-। আর রূপা = ১০ দ্ধ ৫০০ = ৫,০০০/-। মোট ১,০১,০০০/-। রূপার দাম ধরে বর্তমান নেসাব (আনুমানিক) ৫২.৫ দ্ধ ৫০০ = ২৬,২৫০/-। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সোনা ও রূপার গয়না এককভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়েও সমষ্টিগতভাবে নেসাব পরিমাণ হয়ে জাকাত ফরজ হচ্ছে। অনেকেই এ দিকে দৃষ্টি না দেওয়ায় জাকাত অনাদায় থেকে যাচ্ছে। সুতরাং কোনো মহিলার ওপর যদি জাকাত ফরজ হয় এবং তার জাকাত আদায়ের মতো নিজস্ব কোনো অর্থ না থাকে তাহলে তার পিতা, ভাই, স্বামী বা অন্য কেউ যদি তার পক্ষ থেকে জাকাত আদায় করে দেন, তাহলে তার জাকাত আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ তার জাকাত আদায় না করেন, তাহলে তার জাকাত তাকেই আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান হচ্ছে, প্রয়োজনে তিনি গয়না বিক্রি করে জাকাত আদায় করবেন। এর কোনো ক্ষমা বা ছাড় নেই। জাকাত আদায় না করলে, জাকাত অনাদায়ের শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যাকে আল্লাহ তায়ালা ধনসম্পদ দান করেছেন এবং সে ওই ধনসম্পদের জাকাত প্রদান করে না, কিয়ামতের দিন ওই সম্পদ বিষধর সাপে পরিণত হবে। ওই সাপের চোখে দুটি সাদা বিন্দু থাকবে। সাপটি তার গলায় ঝুলতে থাকবে। তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে- আমিই তোমার সঞ্চিত ধন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা আলে ইমরানের একটি আয়াত (১৮০) তেলাওয়াত করলেন- (অর্থ) আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে (সম্পদের জাকাত প্রদান না করে), তারা যেন এটা কিছুতেই মনে না করে, এটা তাদের মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে কৃপণতা করবে, কিয়ামতের দিন ওটাই তাদের গলার বেড়ি হবে। আসমান ও জমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত। (বুখারী, নাসায়ী)
এ তো গেল একটি দিক। আরেকটি দিক হলো- অনেক স্বামী বলেন, গয়না স্ত্রীর, জাকাত দেবে সে। আর স্ত্রীর বক্তব্য হলো, গয়না তার, আমি জাকাত দেব কেন? এমন কাঁদা ছোড়াছুড়ি অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, গয়নার মালিক আসলে কে? ইসলামী অর্থনীতিতে কোনো সম্পদই মালিকানাবিহীন থাকতে পারবে না। যে সম্পদের কোনো ব্যক্তি মালিকানা থাকবে না, সে সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে গয়নার মালিকানা নিয়ে ঠেলাঠেলি বা কাঁদা ছোড়াছুড়ির মাঝে আমাদের সামনে সমাজের কুৎসিত চেহারাটা ভেসে ওঠে। একজন নারী বিয়ের আগে, বিয়ের সময় বা বিয়ের পরে পিতা-মাতা বা নিজের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন কর্তৃক উপহার স্বরূপ যে সব গয়না পেয়ে থাকেন, কিংবা নিজের অর্থ দ্বারা কিনে থাকেন- এ গুলোর সম্পূর্ণ মালিক তিনি নিজেই। সাধারণত এ ধরনের গয়নার মালিকানা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যার কথা জানা যায় না। সমাজের কুৎসিত চেহারাটা দেখতে পাওয়া যায় স্বামী বা স্বামীর আত্মীয় স্বজন কর্তৃক প্রদত্ত গয়নাকে কেন্দ্র করে। বিয়ের সময় বা পরবর্তী কোনো সময় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত মোহর বাবদ বা উপহারস্বরূপ গয়না এবং উপহারস্বরূপ স্বামীর আত্মীয় স্বজন কর্তৃক প্রদত্ত গয়নার জাকাতের প্রশ্ন আসলে স্বামী বলেন, এগুলোর মালিক তার স্ত্রী। কিন্তু - আল্লাহ না করুক- কারো স্বামী মারা গেলে কিংবা স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে- নারীকে যখন স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়, তখন আমাদেরকে সমাজের খুবই নোংরা চেহারা দেখতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, স্বামীর বাড়ির লোকজন স্ত্রীর শরীর থেকে গয়না খুলে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তারা বলেন, আমাদের গয়না নিয়ে তোমাকে যেতে দেব না। আমাদের সমাজের এ এক জঘন্য কদর্যরূপ। জাকাতের সময় গয়নার মালিক স্ত্রী, আর ঘর থেকে বের করে দেওয়ার সময় গয়নার মালিক স্বামী! কী দারুণ বিচার এ সমাজের!
মোহর বাবদ স্ত্রী যে গয়না পেয়ে থাকেন, তার সম্পূর্ণ মালিক তিনি। তিনি ইচ্ছা করলে, এ গয়না দানও করতে পারেন। যাকে খুশি তাকে দিতেও পারেন। বিক্রিও করতে পারেন। তার এ অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ‘আমাদের গয়না’ বলে স্ত্রীর শরীর থেকে গয়না খুলে নেওয়ার কোনো অধিকার স্বামীর বাড়ির লোকজনের নেই। যদি তারা তা করেন, তাহলে কিয়ামতের কঠিন দিনে এর জন্য তাদের জবাব দিতে হবে। এর জন্য তাদের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন কোনো জিনিসের ব্যাপারে নিজের মালিকানার দাবী উত্থাপন করে, যা বস্তুত তার নয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। সে যেন দোজখকে তার ঠিকানা ও আবাস বানিয়ে নেয়। (মেশকাত)
আর স্বামী বা স্বামীর বাড়ির লোকজন যে সব গয়না উপহারস্বরূপ দিয়ে থাকেন, সে সব গয়না ‘আমাদের গয়না’ বলে খুলে নেওয়া বমনকৃত বস্তু খাওয়ার সমতুল্য নিকৃষ্ট কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি স্বীয় উপহার ফেরত নেয়, সে ওই কুকুরের মতো, যে বমি করে এবং তা খায়। (বুখারি ও মুসলিম)
মহিলারা যে সব গয়না মোহর বাবদ কিংবা উপহারস্বরূপ পেয়ে থাকেন, সেগুলোর আসল মালিক মহিলাই, স্বামী নয়। সুতরাং এ সব গয়নার জাকাত তার ওপরই ফরজ হবে। জাকাত আদায়ের মতো তার কোনো অর্থ না থাকলে স্বামী তাকে সহযোগিতা করতে পারেন। ঈদে দামী কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য সাজগোজের পেছনে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে পারলে শতকরা ২.৫ ভাগ হারে তার পক্ষ থেকে জাকাত আদায় করা মোটেও বোঝা হওয়ার কথা নয়। স্ত্রীর যাবতীয় খরচ যদি স্বামী যোগান দিতে পারেন, তাহলে এটাও পারার কথা। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস এর দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মহব্বত আরও গভীর হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন