সোমবার, ৬ জুন, ২০১৬

কিভাবে আমরা রমাদানকে বরণ করবো? (রামাদানের গুরুত্বপূর্ণ ৯ টি আমল)

বছরের সেরা মাস এবং অতীব বরকতময় রমাযান সমাগত। আমাদের সালাফগণ রমজান মাসে যে সকল ইবাদত করতেন তার কিছু অংশ নিম্নে পেশ করা হলো।
১. اَلصِّيَامُ (সাওম আদায় করা)
রমযান মাসের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো সাওম আদায় করা। কোরআন-হাদীসে সাওমের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বহু আলোচনা রয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ.
অর্থ: “হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” (সুরা বাকারা ১৮৩)

فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ .
অর্থ: “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।” (সুরা বাকারা: ১৮৫)
হাদীসে আল্লাহর রাসূল (সা:) রোজার বিশেষ ফজীলতের ঘোষণা দিয়েছেন। তন্মধ্য হতে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِى لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ. وَلَخُلُوفُ فِيهِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ 
অর্থ: “আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন নবী (সা:) বলেছেন: “মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “কিন্তু রোযা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিফল দান করবো। বান্দাহ আমারই জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।”
রোযাদারের জন্য দ’টি আনন্দ রয়েছে। একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি তার প্রতিপালক আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তা’য়ালার কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।”

২. اَلْقِيَامُ (তারাবীহ-র সালাত)
রমযান মাসে দ্বিতীয় প্রধান ইবাদত হলো কিয়ামুল লাইল (তারাবীহ-র সালাত)।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ (رواه مسلم)
অর্থ: “আবূ হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি রমজানে ঈমান এবং ইহতিসাব এর সহিত রাত্রি জাগরণ করল তার পিছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।”

‘ক্বিয়ামুল লাইলের’ (তারাবীহ) এর বিধান কি?
রমজানের ‘ক্বিয়ামুল লাইল’ (তারবীহ) একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:
حَدَّثَنَا النَّضْرُ بْنُ شَيْبَانَ قَالَ قُلْتُ لِأَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ حَدِّثْنِي بِشَيْءٍ سَمِعْتَهُ مِنْ أَبِيكَ سَمِعَهُ أَبُوكَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ بَيْنَ أَبِيكَ وَبَيْنَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَدٌ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ قَالَ نَعَمْ حَدَّثَنِي أَبِي قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَرَضَ صِيَامَ رَمَضَانَ عَلَيْكُمْ وَسَنَنْتُ لَكُمْ قِيَامَهُ 
অর্থ: “নজর ইবনে শাইবান বলেন আমি আবু সালামা ইবনে আবদুর রাহমানকে বললাম, আমাকে তুমি রমজান মাস সম্পর্কে এমন একটি হাদীস শুনাও যা তুমি তোমার পিতার নিকট থেকে শুনেছ এবং তোমার পিতা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর থেকে শুনেছেন, যেন তোমার পিতা এবং রাসূলুল্লাহ (সা:) এর মাঝখানে কোন ভায়া মাধ্যম না থাকে। তিনি বললেন হ্যা! আমার পিতা আমাকে বলেছেন যে, রাসূলূল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ (সুব:) রমজানের সিয়ামকে ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য রমজানের কিয়ামকে (তারাবীহকে) সুন্নত করেছি।” 
এই হাদীস থেকে বুঝা গেল যে, তারাবীহের সালাত রাসূল (সা:) কতৃক ঘোষিত একটি গুরুত্বপূর্ণ।

৩. اَلصَّدَقَةُ (দান-খয়রাত করা)
রমজান মাসের আরেকটি ইবাদত হলো ‘ছাদাকাহ করা’ (অর্থাৎ ফিতরা এবং অন্যান্য নফল ছাদাকাহ প্রদান করা)
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنْ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ
অর্থ: “আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরাঈল (আ:) তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আ:) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসূল্লাহ (সা:) (বসন্ত মৌসুমে প্রবাহিত প্রথম বাতাস) রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন।”

উল্লেখ্য যে, এই হাদীসে ইবনে আব্বাস (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:) এর দানশীলতাকে এমন একটি উপমা দিলেন যা পৃথিবীতে বিরল। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা:) এর দানশীলতাকে বসন্ত মৌসুমের প্রথমে যে বাতাস প্রবাহিত হয় তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার কারণ হচ্ছে ঐ বাতাসের মধ্যে তিনটি গুন থাকে। এক: ঐ বাতাসের মাধ্যমে গাছ-পালা, তরু-লতা, পশু-পক্ষী সহ সকল সৃষ্টিই ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। দুই: ঐ বাতাসের প্রভাবে গাছ-পালা, তরু-লতা সহ সকল কিছুতে খুব দ্রুত পরিবর্তন ও সজীবতা ফিরে আসে। তিন: যেসব গাছ-গাছালি, তরু-লতা ইত্যাদি মৃত্যুর দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল তারা আবার নতুন জীবন লাভ করে।
৪. اِفْطَارُ الصَّائِمِ 
(সিয়ামপালনকারীদের ইফতার করানো)
রমজান মাসে আরেকটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত হলো সিয়াম পালনকারীদের কে ইফতার করানো। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:
عَنْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْتَقِصَ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا 
অর্থ: “জায়েদ ইবনে খালেদ জুহানী (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সায়েমকে ইফতার করালো সে ব্যক্তি উক্ত সায়েমের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। এতে সায়েমের সওয়াবে কোন ঘাটতি হবে না।”

৫. اَلْاِجْتِهَادُ فِيْ تِلَاوَةِ الْقُرْانَ 
(বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা)
রমজানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা। কেননা এমাসেই কুরআনুল কারিম নাজিল করা হয়েছে। মূলত: কুরআন নাজিলের কারণেই এ মাসের এত বড় মর্যাদা। নতুবা পৃথিবীর ইতিহাসে কত রমজান এলো আর গেল কেউ তার খবরও রাখে নাই কিন্তু কুরআন নাজিলের পর থেকে এ মাসের মর্যাদা বেড়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে:
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ.
অর্থ: “রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে।” (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)

অবশ্য কিছু কিছু হাদীস দ্বারা জানা যায় যে অন্যান্য আসমানী কিতাবও রমজান মাসে নাজিল করা হয়েছিল। তাফসীরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। 
عن واثلة -يعني ابن الأسقع أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال أنزلت صُحُف إبراهيم في أول ليلة من رمضان وأنزلت التوراة لسِتٍّ مَضَين من رمضان والإنجيل لثلاث عَشَرَةَ خلت من رمضان وأنزل الله القرآن لأربع وعشرين خلت من رمضان وقد روي من حديث جابر بن عبد الله وفيه: أن الزبور أنزل لثنتَي عشرة ليلة خلت من رمضان 
অর্থ: “ওয়াসিলা ইবনে আসকা’আ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেনঃ ইবরাহিম (আ:) এর সহিফাসমূহ রমজানের প্রথম রাতে, মূসা (আ:) এর তাওরাত রমজানের ষষ্ঠ তারিখে, ঈসা (আ:) এর ইঞ্জিল রমজানের তের তারিখে এবং কুরআনুল কারীম রমজানের চব্বিশ তারিখে নাজিল হয়েছে। জাবের (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীসে আরো বলা হয়েছে দাউদ (আ:) এর যাবুর নাজিল হয়েছিল বারই রমজানের রাতে।”

রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজেও রমজান মাসে বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত করতেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنْ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ 
অর্থ: “আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন , রাসূলুল্লাহ (সা:) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরাঈল (আ:) তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আ:) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন।

চলবে... (আগামী পর্বে সমাপ্ত ইনশাআল্লাহ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন