রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬

প্রেমের সফরে বাইতুল্লার ছায়ায়


লেখক : আবু তাহের মিসবাহ
বাইতুল্লাহর সঙ্গে মুমিনের কলবের এমনই এক মধুর সম্পর্ক যে, বাইতুল্লাহর জিয়ারত-সুধা যতই পান করো, পিপাসা আরও বৃদ্বি পায়; হৃদয় আরও তৃষ্ণাকাতর হয়। বাইতুল্লাহর দীদার মুমিনের দিলকে আরও বেকারার করে। আল্লাহর ঘর একবার দেখে আসার পর আবার দেখতে পাওয়ার আকাক্সক্ষা অন্তরে প্রবলভাবে জাগ্রত হয়। কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহর জামাল ও সৌন্দর্য কখনও শেষ হয় না। তাই মুমিনের হৃদয়ে সে সৌন্দর্যের পিপাসাও কখনও মেটে না, আরও বাড়ে; বাড়তেই থাকে’’। ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিচারণের পর এভাবেই শুরু হয়েছে বাইতুল্লাহর ছায়ায় বইটি। বাইতুল্লাহর মুসাফির খ্যাত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহর এটি দ্বিতীয় হজের সফরনামা। হজ ও ওমরা নিয়ে হয়তো আরও অনেকে লিখেছেন। কিন্তু কষ্ট ও ত্যাগের এ সফরটি যে কত প্রেমময় এবং মধুর হতে পারে, এ বইটিতে পাঠক তা বুঝতে পারবেন স্বার্থকভাবে। শুধু ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও মক্কা-মদিনার পরিস্থিতি নয়। একজন মুমিনের আত্মার সঙ্গে বাইতুল্লাহর কি সম্পর্ক, মুমিন হৃদয় কেন বারবার ব্যাকুল হয়ে ছুটে যায় মক্কা-মদিনা, শুরুর দিকে লেখক সেটিই তুলে ধরেছেন ‘অন্তহীন পিপাসা’ শিরোনামে। এখনকার বাস্তবতা ও আমাদের হৃদয়ের কদর্যতার কারণে অধিকাংশ মানুষের কাছেই হজ হল একটি অর্থকেন্দ্রিক ভ্রমণ। লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে হজ করা হলেও ব্যক্তিগত জীবনে এর কোনো প্রভাব সৃষ্টি হয় না। এর মূল কারণ হল হজের মতো এত বড় একটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদাতের মাহাত্ম্য আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়নি। যার ফলে এ মহান ইবাদাতের বরকত থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এমনকি হজের শিক্ষা ও প্রাকটিকেল আমল শেখানোর জন্য তিন মাস বা ছয় মাসের কোর্স আয়োজন করার জন্য আলেমদের তিনি অনুরোধ জানান। বাইতুল্লাহর দিকে যখন যাত্রা শুরু হয়, তখন তো মুমিন বান্দার দিল পুরোপুরি নিবদ্ধ থাকে আল্লাহর দিকে। কথাটিকে লেখক এভাবে ফুটিয়ে তুলেন, ‘‘বিমানে আরোহণ করছি। হঠাৎ মনে হল, জান্নাতে শহীদানের রূহ পাখীর ভিতরে করে উড়ে বেড়াবে। আমরা কি তাহলে বাইতুল্লাহর শহীদান! ডানা-মেলা এই পাখীটির ভিতরে করে মনের আনন্দে আমরা উড়ে যাব মেঘের রাজ্য পার হয়ে সেই সুদূরে, আল্লাহর ঘর যেখানে!’’ এভাবে ভাবের সিজদায় অবনত হয়ে লেখক শুরু করেন তার বাইতুল্লাহর সফর। আল্লাহর ঘরে বারবার হাজির হওয়ার ভাগ্য সবার হয় না। এমন সৌভাগ্য যারা অর্জন করেন তারা মহা সৌভাগ্যবান। আমাদের মাওলানা আবু তাহের মিসবাহও এমন মহা সৌভাগ্যবানদের একজন। যার জীবনের প্রথম হজের সফর হয়েছে আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে। জীবনের প্রথম হজেই তিনি বিখ্যাত বুজুর্গ হাফেজ্জী হুজুর (র.)-এর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। সে সৌভাগ্যের ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ছোট এই জীবনের প্রায় অনেক রমজান তিনি অতিবাহিত করেছেন বাইতুল্লাহর ছায়ায়। আল্লাহর ঘরের সঙ্গে একবার যার মনের বন্ধন হয়ে যায়, সে বাঁধনে মন আটকে থাকে জীবনভর। এ জন্য হজের সফরে অনেক কষ্টই হালকা মনে হয় বাইতুল্লাহ প্রেমিকদের। কিন্তু বাহ্যিকভাবে আমরা দেখি যে, হজের সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানা ভোগান্তিতে ভুগতে হয় আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের। এ জন্য নতুনদের কাছে হজের সফরটা অনেকটা অজানা আতংকের। আবার যারা হজ করে ফিরে আসেন, তাদের কথাবার্তায় মক্কা-মদিনার চেয়ে সফরের কষ্ট ও ভোগান্তির কথাই বেশি থাকে। এতে অন্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এ বিষয়গুলোর সমাধান খুব সুন্দর ও বাস্তবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাইতুল্লাহর ছায়ায় বইটিতে। অনেক সময় আমাদের কিছু আচরণ ও নিয়মভঙের কারণেই বিপত্তি দেখা দেয়। অন্যান্য সাধারণ ভ্রমণের মতোই আমরা যাত্রা শুরু করি হজের উদ্দেশ্যে। আমরা যে মহান প্রভূর আমন্ত্রণে তার ঘরে যাচ্ছি, সে উপলদ্ধি থাকে না অনেক সময়। এ জন্য হজের যাবতীয় আদাব রক্ষা হয় না। এ জাতীয় খুটিনাটি সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর প্রতি কিভাবে হাজী সাহেবান যত্নবান হবেন, তা লেখক বর্ণনা করেছেন বেশ চিন্তা-ভাবনা করেই। কারণ, আল্লাহ যেমন বড়। তার ঘরের আদব-কায়দাও তত বেশি। মক্কা-মদিনার প্রতিটি স্থানের কথা আলাদা করে জায়গা পেয়েছে এ সফরনামাটিতে। প্রতিটি জায়গার সঙ্গে হৃদয়ের প্রেম-ভালোবাসার যত উপাদান লুকিয়ে আছে, তা লেখক তুলে এনেছেন স্বার্থকতার সঙ্গেই। এ সফরনামাটি পড়ে পাঠক মক্কা-মদিনার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক অনুভব করবেন। হজ ও ওমরার প্রকৃত স্বাদ পেতে প্রেমময় এ গ্রন্থটি হতে পারে উত্তম পাথেয়। কারণ এ জাতীয় সফরনামা লিখতে প্রয়োজন, আত্মার স্বচ্ছতা ও সোনালী পরশে আলোকিত হৃদয়। লেখক আবু তাহের মিসবাহর ক্ষেত্রে এ গুণগুলোর প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছে। প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের সুপ্ত একটি বাসনা হল আল্লাহর ঘর জিয়ারতের স্বপ্ন। লেখক তা ব্যক্ত করেছেন এভাবে। “জীবনে স্বপ্ন দেখা কখনও শেষ হয় না। আমাদের জীবনে দিন-রাত আছে; আমাদের স্বপ্নেরও আছে দিন-রাত। যখন শুধু স্বপ্ন দেখি তখন হল স্বপ্নের আঁধার রাত, স্বপ্ন যখন পূর্ণ হয় তখন হল স্বপ্নের আলোকিত দিন। জীবনে যেমন আসে রাতের পর দিন, স্বপ্নেও আসে আঁধার রাতের পর আলোকিত দিন। জীবনের দিন-রাতের মতো এভাবেই চলতে থাকে স্বপ্নের রাত-দিন। জীবন যখন শেষ হবে তখনই শুধু শেষ হবে আমাদের স্বপ্ন দেখা! কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের স্বপ্ন লালন করা! জানি না, এ কোন্ নেশা! এ কেমন পিপাসা! পেয়ালায় যত ঠোঁট ভেজাও তত নেশা জমে, যত পান কর তত পিপাসা জমাট বাঁধে! এভাবে আশিক বান্দার, প্রেমের নেশায় মাতাল হওয়া এবং মিলনের পিপাসায় কাতর হওয়া দেখতে আল্লাহর হয়তো ভালো লাগে!” এখনও যারা বাইতুল্লাহর সফর করেননি, এ বইটি হতে পারে তাদের জন্য আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা। আর যারা হজ-ওমরা করে এসেছেন, বাইতুল্লাহর সময়টুকু স্মৃতিচারণের জন্য ও আবারও যাওয়ার আগ্রহ সৃষ্টিতে বইটি হবে বেশ উপকারী। সর্বপুরি প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহর ঘরের ভালোবাসা সৃষ্টিতে এ সফরনামাটি একটি উপকারী সুখপাঠ্য হবে বলে আশা করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন