"সে আমাকে কথা দিয়েছিল, জীবনের
প্রতিটি মুহূর্তে আমার পাশে থাকবে।
কিন্তু সে কথা রাখে নি। চলে গেছে
আমাকে ছেড়ে।"
.
কাঁদছিলেন আর কথাগুলো বলছিলেন
মুহাম্মাদ বিলাল (জন্মসূত্রে
বাংলাদেশী) । মিনার
হাসপাতালের দেয়ালে হেলান
দিয়ে বসে আছেন। সাদা ইহরামের
কাপড় এখানে ওখানে ছিঁড়ে গেছে।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরে রোদে
চিকচিক করা বালিয়াড়ির দিকে।
.
.
কেমন যেন হয়ে গেছেন। উদ্ভ্রান্তের
মতো। স্ত্রী মৃত – এটি নিশ্চিত জেনেও
হঠাৎ করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
আরেক বাংলাদেশীর কাছে
জিজ্ঞেস করছেন,
.
"আমার স্ত্রীকে দেখেছেন আপনি?
সে কোথায় আছে? কেমন আছে সে?"
.
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিতীয়
বাংলাদেশী আবদুল আলীম তার
কাঁধে সান্তনার হাত রাখলেন। বাকরুদ্ধ
কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও পারেন না।
এবার দু’জনে একসাথে ডুকরে কেঁদে
ওঠেন। আরেকজন এগিয়ে এসে পবিত্র
কুরআনের একটি আয়াত পড়লেন। থাকতে
না পেরে তিনিও কেঁদে ফেললেন।
ভাই মুহাম্মাদ বিলালের দুঃসহ ব্যথা
অনুভব করতে কোন বেগ পেতে হচ্ছে না
কারোও!
.
.
বিলালের মর্মব্যথা চারপাশ ভারী
করে চলেছে –
.
"আমার স্ত্রী চলে গেছে! সে তো
হাজ্জ্বটা শেষ করে যেতে পারল না!
সে আমার সাথেই ছিল। আমি তার
হাতটা ধরে ছিলাম। সে মরে গেল!
আমাদের তিনটা সন্তানকে এখন কে
দেখবে!"
.
পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদলে অন্যদেরও
স্থির থাকা কঠিন হয়ে যায়। বিলাল
কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে চলেছেনঃ
.
"আমি আজ বিশ বছর ধরে সৌদি আরবের
যাহরানে কাজ করছি। আরও আগে
দেশে ফিরে যেতাম। শুধু আমার
স্ত্রীকে হাজ্জ্ব করিয়ে দেশে যাব – এ
কারণেই এতটা কাল কষ্ট করে থেকে
গেছি। তিল তিল করে টাকা
জমিয়েছি ওকে হাজ্জ্বে আনার
জন্যে। বেচারীর বড় শখ ছিল হাজ্জ্ব
করার। কিভাবে, কোত্থেকে তার
হাজ্জ্বের প্রতি এত আগ্রহ তৈরী হলো,
বলতে পারবো না। তার এত আগ্রহ দেখে
আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাকে
হাজ্জ্ব না করিয়ে দেশে যাব না।"
.
.
একটু থেমে দুঃখগাঁথা বুনতে শুরু করলেন
আবার,
.
"এবার দু’জনে একসাথে দেশে ফিরে
যাওয়ার কথা ছিল। জীবনের বাকি
দিনগুলো একসাথে থাকার কথা ছিল।
কিন্তু সে তো থাকলো না। আমি এখন
দেশে গিয়ে কী করবো? কিভাবে
তিন সন্তানকে আমার মুখ দেখাব?
আসার সময় তিন সন্তানকে ধরে সে এত
বেশি কেঁদেছিল ও... তখন কেউ কেউ
বলেই ফেলেছিল – এটা তো শেষ
বিদায়েরই কান্না! সেটাই তো ফলে
গেল!
.
... আমি আর সে কংকর নিক্ষেপ শেষ
করেছি। ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা।
ফিরে যাচ্ছি মিনার তাঁবুতে ২০৪
নাম্বার পথ ধরে। হঠাৎ উল্টো দিক
থেকেও হাজ্জ্বীরা আসতে শুরু করলেন।
আমরা দৌড়ে সরে যেতে চেষ্টা
করলাম। কিন্তু আমাদের লাইনেই এত
ভীড়; কোনদিকে সরে যাবার উপায়
ছিল না। মুখোমুখি ধাক্কা লাগার
সাথে সাথে অনেক লোক মাটিতে
পড়ে গেল। আমার স্ত্রীও পড়ে গেল।
সাথে আমিও। আমাদের দু’জনের উপর
আরও অনেকে পড়লেন। আমার দমবন্ধ হয়ে
এলো যেন। নিচের পিচঢালা পথ তখন
আগুনের চেয়েও বেশী উত্তপ্ত। পড়ার
সাথে সাথেই চামড়া ঝলসে গেল।
ব্যথার কারণেই কি না জানি না,
আমি সর্বশক্তি ব্যয় করে কোনও রকমে
নিজেকে বের করে আনতে সক্ষম হলাম।
দাঁড়িয়েই দেখতে পেলাম ও’ তখনো
চাপা পড়ে আছে। মুখটা হাঁ হয়ে
গেছে। দু’চোখ আকাশের দিকে।
হাউমাউ করে চীৎকার করে উঠলাম –
আমার স্ত্রীকে বাঁচাও! আমার
স্ত্রীকে বাঁচাও! কিন্তু কে কার কথা
শুনবে! সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
স্ত্রীকে টেনে বের করার চেষ্টা
করলাম। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ!
.
তবে একটা কথা ভেবে সান্তনা
পাচ্ছি – সে কালিমা-ই-শাহাদাত
পড়তে পড়তে মারা গেছে! আর মক্কা-
আল-মুকাররমার পবিত্রভূমিতে সমাহিত
হবে সে ইনশআল্লাহ। এমন সৌভাগ্য
কয়জনের হয়!"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন