তাঁর সম্মানিত পিতার নাম— ‘আবদুল্লাহ’। তাওহিদ ও আবদিয়াতের প্রতি কী সুস্পষ্ট ইশারা! মুহতারামা মা জননীর নাম— ‘বিবি আমেনা’। যে নামের অর্থে লুকিয়ে আছে শান্তি ও নিরাপত্তার শত প্রতিশ্রুতি! পৃথিবীতে চোখ মেলেছেন তিনি এতিম হয়ে। সোনা-মানিকের চাঁদমুখ দেখার আগেই চলে যেতে হয়েছিলো তাঁর সম্মানিত পিতাকে আখেরাতের অনিবার্য ও অনন্ত সফরে! যাঁকে হতে হবে সারা পৃথিবীর কাণ্ডারি, তাঁর কাণ্ডারিও তো হবেন তিনিই, যিনি সারা পৃথিবী নয় শুধু— কুল-মাখলুকাতের কাণ্ডারি! তাই এটাই স্বাভাবিক ছিলো যে, তাঁর জন্মের বাহ্যিক মাধ্যমটুকু ছাড়া আল্লাহ একেবারে প্রথম থেকেই তাঁকে একান্ত নিজের আশ্রয় ও তত্ত্বাবধানে বড় করবেন। আগামী দিনের রাসূল হিসাবে তৈরী করে তোলবেন। অন্য কারো অংশিদারিত্ব মেনে নেবেন না।
দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর ডাক নাম রাখলেন— ‘মুহাম্মদ’, ‘সর্বোচ্চ প্রশংসিত’ যার অর্থ। গুণবান মানুষের উপযুক্ত নাম। দ্বিতীয় নাম ছিলো— ‘আহমাদ’। যাঁর জীবন কেটেছে স্রষ্টার গুণ-কীর্তন ও প্রশংসায়। যাঁকে আখেরাতে দাঁড়াতেও হবে ‘মাকামে হামদ’ বা প্রশংসা-মঞ্চে, তাঁর জন্যে এরচে’ ভালো ও উত্তম নাম আর কী হতে পারে?
অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে এমন এক শৈশবকাল কাটিয়েছিলেন তিনি, খোদ নির্মলতা ও নিষ্পাপতাও যে শৈশবের উপর গর্ব করতো। যৌবনে পদার্পণ করলেন যখন, তখন তাঁর সুকুমারবৃত্তি, পরহেযগারি, সত্যানুরাগ ও সৃষ্টির সেবা— তাঁকে ডাকতে লাগলো হাতছানি দিয়ে অবিরত!
এমনিতেই যৌবন হয় উম্মাদনা-উচ্ছল। তারপর আবার সে-ই দেশ, সে-ই সম্প্রদায়ের ভেতর, যেখানকার জীবনযাত্রা বিলাস-মাতাল। প্রবৃত্তিপূজারী। পাপাচার-অনাচারের সকল দরোজাই যেখানে উন্মুক্ত। যেখানে প্রতিটি উন্মাদ পদস্খলনের উপর প্রচলিত প্রথা ও ‘ফ্যাশনের’ মোহর মারা।
সে-ই পরিবেশে, সে-ই বয়সে জাহেলি যুগের-অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর একদল বাসিন্দা তাঁকে উপাধী দিলো— ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত)। এই ‘আল-আমীন’ শব্দটি এমন ব্যাপক ও বিস্তৃত, ইংরেজিতে শুধু virtoys’ দ্বারাই এর তরজমা করা যেতে পারে। অর্থাৎ মুহাম্মদ একাধারে ছিলেন বিশ্বাসভাজন, সত্যবাদী, আনত দৃষ্টির অধিকারী এবং সবার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ।
আকৈশোর মেষ চরিয়েছেন তিনি। সামনে চলে যাঁকে উম্মতের রাখালি ও পাহারাদারির দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে হবে, তাঁর জন্যে এ মেষ-রাখালি ছিলো কতো উপযোগী ও উন্নত শিক্ষা!
যৌবনে নেমেছেন তিনি ব্যবসায়।
ভবিষ্যতে যাঁর প্রধান ব্রত হবে সুলভ মুল্যে জান্নাতের ‘শেয়ার সার্টিফিকেট’ ব্যাপকভাবে বাজারজাত করা— তাঁর জন্যে যৌবনে বাণিজ্য পেশা কতোই না সঙ্গত ছিলো! তাঁর আমানতদারি, দিয়ানতদারি (ধার্মিকতা) এবং ব্যবসায় তাঁর অভিজ্ঞতা দেখে অঢেল সম্পদের ‘মালিকান’ এক পুণ্যবতী বিধবা তাঁর কাছে বিবাহের পয়গাম দিলেন নিজে। ২৫ বছর বয়সে এই গুণবান যুবকের দাম্পত্য জীবনও শুরু হয়ে গেলো। চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়ত প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে শুরু হলো তাঁর সৌভাগ্যময় জীবনের আরেক সফর, এতোদিন ধরে চলছিলো যার পূর্ব-প্রস্তুতি।
তেইশ বছর পর্যন্ত তিনি পৌঁছে গেলেন স্বীয় প্রতিপালকের পয়গাম— মানুষের কাছে। তিনি বিবাহ করেছেন একাধিক। তাঁর সন্তান-সন্ততিও ছিলো। স্বদেশ ও স্বজাতির সাথে সত্যের খাতিরে, ইসলামের স্বার্থে বারবার তাঁকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে রক্তক্ষয়ী প্রচণ্ড যুদ্ধে। প্রতিবেশী দেশ সমূহের সাথে সন্ধি-চুক্তিও সম্পাদন করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর হাতে স্থাপিত ‘ইসলামী খিলাফত’-এর সার্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার প্রতি তাঁকে তীক্ষ্ম নজর রাখতে হয়েছে।
কখনো তাঁকে বসতে হয়েছে বিচারপতির আসনে। কখনো বিবাহের মজলিসে। অমুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও ছিলো তাঁর চিঠিপত্রের লেন-দেন।
অগণিত সালাত আদায় করেছেন তিনি জীবনে। উম্মতের সামনে দাঁড়িয়ে কতো-যে খুতবা ও উপস্থিত-বক্তৃতা দিয়েছেন, তার হিসাব আল্লাহই ভাল জানেন।
মোটকথা; দুনিয়ার প্রতিটি দিক সম্পর্কেই তাঁর অভিজ্ঞতা ছিলো। কিন্তু দুনিয়ার বেড়াজাল তাঁকে আটকাতে পারে নি মুহূর্তের জন্যেও। যেনো কোনো ডুবুরী সাগরে ডুব দিয়ে উঠেছে, অথচ ভিজে নি তার একটি পশমও। যখন তেষট্টি বছর বয়সে ৬৩২ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে এই বিলীয়মান দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন তিনি, তাঁর হৃদয়ে জীবন্ত ছিলো ‘সর্বোত্তম বন্ধু’র দীদার লাভের তামান্না! পবিত্র ও নির্মল ওষ্ঠযুগল থেকে ভেসে আসছিলো—
اللَّهُمَّ فِي الرَّفِيقِ الأَعْلَى
‘হে আমার আল্লাহ! হে আমার সর্বোত্তম বন্ধু’-র আওয়াজ!
উম্মতের জন্যে রেখে গেছেন তিনি এই উপদেশমালা—
‘নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা-চেতনাকে দুনিয়ার বিশৃঙ্খলা ও জঞ্জালে ফাসাবে না। দুনিয়ার বাহ্যিক সাজ-সরঞ্জাম ও উপায়-উপকরণের ধোকায় পড়বে না। তবে নির্দ্বিধায় তা থেকে খিদমত নিতে পারো। কিন্তু ভরসা ও আস্থা রাখবে শুধু সেই অদেখা-মাওলার উপরই! তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা ও পালনকর্তা। জীবন তিনিই দেন। তিনিই মৃত্যুদান করেন। পুনরুত্থিত করবেন তিনিই। স্বীয় সত্ত্বায় কিংবা গুণাবলীতে তাঁর কোনো অংশীদার নেই। জীবনের ছোট-বড় প্রতিটি কাজে কর্মে দায়িত্ব-সচেতন হও। পার্থিব জীবনকে অস্তিত্বের ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত নগণ্য ও সীমাবদ্ধ একটি অংশ মনে করবে। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনো কাজ করে তা-কে ‘সবকিছু’ মনে করে ধোকায় পড়বে না। এই ‘আজ’ সত্ত্বরই ‘কাল’ হবে। সেদিন দিতে হবে সবকিছুর পুঙ্খাণুপুঙ্খ হিসাব। সম্পন্ন করো সমস্ত প্রস্তুতি সে-ই সেদিনের জন্যে।’
আর উম্মতের জন্যে তিনি জারি করে গেছেন এই কানুন ও নীতিমালা—
‘কোনো অবস্থায়ই জুলুম করো না। ছোট বা বড় হওয়া এই মাটির পৃথিবীর বুনিয়াদী কানুন। কেউ হবে আমির আর কেউ ফকির। কিন্তু বড় দাবিয়ে রাখবে ছোটকে, আমির নিষ্পোষিত করবে গরিবকে, এবং শাসক শোষণ করবে শাসিতকে— এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। স্বামী-স্ত্রী, শাসক-শাসিত ও ধনী-গরিব সবাই অধিকার আদায়ের দাবিতে আল্লাহর ন্যায় বিচারের মানদণ্ডে বরাবর। ফরয আদায়ের ব্যাপারে সীমাহীন গুরুত্ব প্রদান করবে। পুঙ্খাণুপুঙ্খরূপে আদায় করবে তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। অধিকার আদায়ের নাম করে হাঙ্গামা ও হট্টগোল সৃষ্টি করবে না। দুনিয়াকে হাঙ্গামা ও অশান্তির নরক বানাবে না। তলোয়ার যদি ওঠাতে হয়, তাহলে তা যেনো হয় শুধু শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যে। আল্লাহর হুকুমতের প্রতিপত্তি বিস্তার করার জন্যে। সুদ, ঘুষ ও খেয়ানতের এক- একটি পয়সাকে হারাম মনে করো। নির্লজ্জতার ধারে কাছেও যেয়ো না। অশ্লীল গান-বাজনা ও নৃত্য-গীতের প্রতি বিন্দুমাত্র আসক্তি মনে ঠাঁই দেবে না। মাদকদ্রব্যে হাত লাগাবে না। ‘মীরাস’ বা উত্তরাধিকার বণ্টন করে দাও সমস্ত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সঠিক হিসাব অনুযায়ী। এমন যেনো না হয় যে বড় ছেলেই পেয়ে গেলো সবকিছু আর ছোট ছেলে-মেয়েরা রয়ে গেলো শুধু মুখ দেখার জন্যেই। জুয়ার কামাইকে চুরির মালের মতোই পংকিল মনে করবে। অপরিচিতা ও বেগানা মহিলার প্রতি দৃষ্টি পর্যন্ত তুলবে না। তবে নেহাৎ প্রয়োজন হলে এবং কোনো কল্যাণের খাতিরে ইসলামী শরীয়া মুতাবিক প্রত্যেকের হক ও অধিকার আদায়ের শর্তে একাধিক বিবাহের অনুমতিও রইলো।’
মোটকথা; এই সমস্ত হিদায়াত-বাণীকে আপন প্রতিপালকের কাছ থেকে শেখে এবং শিখিয়ে যখন এই ‘রাহবারে আজম’ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন, তখন পৃথিবীতে রেখে গেলেন পরিপূর্ণ এক হিদায়াতনামা। দিয়ে গেলেন এক সর্বব্যাপী ও বিশদ কর্মপন্থা। তাঁর এই হিদায়াত ও শিক্ষার কথা তিনি যে কেবল বলেই গেছেন তা নয়, বরং তাঁর বাস্তব জীবনে রূপায়িত করেও দেখিয়ে গেছেন।
স্বগোত্রের মূর্খ ও সীমালঙ্ঘনকারীরা তাঁর পিছু নিলো, তখন দাওয়াতের কাজকে সফলতার দ্বার-প্রান্তে পৌঁছানোর জন্যে তাঁকে দেশান্তরিত হতে হলো। আড়াইশ-পৌনে তিনশ মাইলের মরুপথ পাড়ি দিয়ে হিজরত করতে হলো মদীনায়। নির্দয়, নিষ্ঠুর আচরণের এমন কোনো দিক বাকি ছিলো না, যা তাঁকে এবং তাঁর ওফাদার সাহাবীদেরকে সইতে হয় নি। কিন্তু এ-সব কিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অ-জাগতিক ইস্পাত কঠিন মনোবল ও হিম্মত দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলেন তিনিই। কুদরতি শক্তি তাঁর সামনে পানি করে দিল সব বাধার বিন্ধ্যাচল। আপন সান্নিধ্য পরশে তৈরী করে গেছেন লক্ষাধিক সাহাবীর এক মুবারক জামাত। প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন আরবে দশ লাখ বর্গমাইলের বিশাল ভু-খণ্ডে ন্যায় ইনসাফভিত্তিক এক কালজয়ী আদর্শ শাসন-ব্যবস্থা। তাঁর সর্বব্যাপী, বে-নজির সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য ও পূর্ণত্বের আকর সুমহান ব্যক্তিত্বকে কেবল আমাদেরকইে নয়, ইউরোপকেও স্বীকার করে বলতে হয়েছে—
The Most Successful of All Prophets and Rellgious Personal it’s.
অর্থাৎ ‘তিনি পৃথিবীর সমস্ত নবী-রাসূল এবং খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সফলতম ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হয়েছেন।’
তাঁর আনীত বে-নজির ও দৃষ্টান্তবিহীন কালামুল্লাহ—আল্লাহর কালামের জন্যেও এই ইউরোপই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে—
“The most wideiy Read Book in Exibtence”
অর্থাৎ এ‘রচে’ বেশি প্রচারিত ও পঠিত কিতাব পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই’।
সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের মুখে এ-ই সশ্রদ্ধ প্রশংসা তিনি ছাড়া আর কে লাভ করতে পেরেছেন ?