প্রশ্ন: কোনো পরপুরুষের পাশ দিয়ে যাওয়া লাগবে না, একথা জানা থাকলে নারী কি স্বামীর সাথে বাইরে যাওয়ার সময় সুগন্ধি লাগাতে পারবে? কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে কিংবা কোনো জরুরী পরিস্থিতিতে পড়ে যদি কোনো পুরুষ তার সুগন্ধির সুঘ্রাণ পেয়েই যায়, তাহলে সেই নারীর কি পাপ হবে?
প্রশংসা মাত্রই আল্লাহ্র জন্য।
নারীদের সুগন্ধি ব্যবহারের ক্ষেত্রে হুকুম কী তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে:
[১] স্বামীর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা। এটি মুস্তাহাব এবং এমনটি করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ এটি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর সদয় আচরণেরই একটি অংশ এবং একজন আরেকজনের পছন্দের ব্যাপারে মনোযোগী হলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
আল-মান্নাবি তাঁর ফাইদ আল-ক্বাদীর (৩/১৯০) এর মধ্যে বলেছেন:
“স্বামীর জন্য সুগন্ধি লাগানো এবং নিজেকে সুসজ্জিত করার ব্যাপারে বলা যায়, এমনটি করা আবশ্যক এবং একটি পছন্দনীয় কাজ। জনৈক বিজ্ঞ লোক বলেছেন, স্বামীর জন্য একজন স্ত্রীর নিজেকে সুসজ্জিত করা এবং সুগন্ধি লাগানো তাদের মাঝে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির অন্যমত শক্তিশালী কারণ। এটি ঘৃণা এবং অপছন্দকে দূরে হটিয়ে দেয়। কারণ চোখ হলো হৃদয়ের পথপ্রদর্শক। চোখ মনোহর কিছু দেখলে হৃদয়ে তার সংবাদ পৌঁছে যায় এবং ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। কিন্তু চোখ যদি পড়ে কোনো কুৎসিত কিছুতে অথবা পোশাক পরিচ্ছদে এমন কিছু দৃষ্টিগোচর হয় যা চোখের ভালো লাগে না, তাহলে সেই সংবাদও হৃদয়ে পৌঁছে যায়। ফলে ঘৃণা আর অপছন্দের সৃষ্টি হয়। সে কারণেই আরবের নারীরা একে অন্যকে উপদেশ দিয়ে বলতো: স্বামী এমনকিছু দেখে ফেলার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে যা সে পছন্দ করে না অথবা তোমার থেকে এমন কোনো গন্ধ পাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে যা তার বিতৃষ্ণার কারণ হতে পারে। [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]।
[২] সুগন্ধি লাগিয়ে পরপুরুষকে শোঁকানোর জন্য বাইরে বের হওয়া। এমনটি করা হারাম এবং একটি বড় পাপ (কবীরা গুনাহ্)।
আবূ মুসা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করা হয় যে, আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন: "যদি কোনো নারী সুগন্ধি লাগিয়ে লোকজনের পাশ দিয়ে যায় যাতে তারা তার সুগন্ধির সুঘ্রাণ অনুভব করে, তাহলে সে হলো ঐ রূপ," এবং তিনি কথাগুলো কঠোরভাবে উচ্চারন করেন- অর্থাৎ একজন ব্যভিচারিণী।
হাদিসটি আবূ দাঊদ (৪১৭৪) এবং আত্-তিরমিযি (২৭৮৬) সংকলন করেছেন; ইবন দাক্বীক্ব আল-ঈদ আল-ইক্বতিরাহ্ এর মধে এবং আল-আলবানি সহীহ্ আত-তিরমিযি-তে হাদিসটিকে সহীহ্ বলে রায় দিয়েছেন।
আল-মান্নাবি তাঁর ফাইদ আল-ক্বাদীর (১/৩৫৫) এর মধ্যে বলেছেন:
“সে হলো ব্যভিচারিণী” এর অর্থ হলো: তেমনটি করার কারণে সে ব্যভিচারের দিকে ধাবিত হয় এবং ব্যভিচার সংঘটিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে এবং যারা ব্যভিচার খোঁজে তাদেরকে সেই কর্মে আহ্বান জানায়। এ কারণেই তাকে রূপকার্থে ব্যভিচারিণী বলা হয়েছে। কারণ এখানে যৌনকামনা জয়ী হতে পারে এবং ব্যভিচার সংঘটিত হতে পারে। তার পুরুষের পাশ দিয়ে চলাকে পুরুষের চলার পথে তার বসে থাকার সাথে তুলনা করা হয়েছে যেন পুরুষরাই তার পাশ দিয়ে চলে। [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]
[৩] নারী যদি এই ভেবে সুগন্ধি লাগিয়ে বাইরে যায় যে, কোনো পুরুষের পাশ দিয়ে তার যাওয়ার সম্ভাবনা নেই এবং কোনো পুরুষ তার সুগন্ধির সুঘ্রাণ পাবে না, তারপরও তেমনটি করা তার জন্য হারাম। যদিও পুরুষদেরকে প্রলুব্ধ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই, তারপরও তা করা তার জন্য হারাম। কারণ এমনটি করাই হলো এক ধরনের ফিতনা। শারিয়াহ্ থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এমনটি করা হারাম এবং অবৈধ।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, (মুসলিম) স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহ্র সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”
[আন-নূর; ২৪:৩১]
কাজেই পরপুরুষের সামনে নিজের সাজ-সজ্জা প্রকাশ করা নারীদের জন্য হারাম। এবং নিঃসন্দেহে সুগন্ধি নারীর সাজ-সজ্জার একটি। অতএব, এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সুগন্ধিও অন্তর্ভুক্ত।
বর্ণনা করা হয় যে, আবদুল্লাহ্ ইবন মাস‘ঊদের স্ত্রী যায়নাব বলেন: আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে বলেছেন: “যদি তোমাদের কেউ মাসজিদে আসে, সে যেন সুগন্ধি না লাগায়।” – মুসলিম (৪৪৩)
রাসূল (ﷺ) যদি নারীদেরকে সুগন্ধি লাগিয়ে মাসজিদে আসতে বারন করে থাকেন এই কারণে যে, নারী-পুরুষের মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায় এবং নিকট দুরত্বের ফলে পুরুষরা একটু-আধটু সুঘ্রাণ পেয়ে বসতে পারে, তাহলে এটাই স্বাভাবিক যে, সুগন্ধি লাগিয়ে নারীদের বাজার-ঘাটে যাওয়ার অনুমতি নেই। যদিও একে বড় পাপ বিবেচনা করা হয় না, তবে সুস্পষ্টভাবেই এমনটি করা হারাম।
আল-যাওয়াজির ‘আন ইকতিরাব আল কাবা‘ইর (২/৭১-৭২) গ্রন্থে ইবন হাজার আল-হাইতামি বলেছেন:
যে হাদিসে এটাকে কবীরা গুনাহ্ বলা হয়েছে সেই হাদিসের ব্যাখ্যা করতে হবে এভাবে যে, এটা কবীরা গুনাহ্ হবে যদি নির্ঘাত ফিতনা সৃষ্টি হওয়া নিশ্চিত থাকে। যেখানে ফিতনা সৃষ্টির শুধু আশংকা থাকে সেখানে এটা মাকরুহ্ অথবা যদি সে (নারী নিজেই) মনে করে যে তা ফিতনা সৃষ্টি করবে, তাহলে তা হারাম কিন্তু কবীরা গুনাহ্ নয় যেটা স্পষ্ট। [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]
[৪] কোনো নারী যখন সুগন্ধি লাগায় এবং মনে করে যে, তার সুগন্ধি লোকজনের কাছে পৌঁছবে না এবং পরপুরুষেরা তার কোনো সুঘ্রাণ পাবে না, যেমন হয়ত সে তার স্বামীর গাড়ীতে করে কোনো নির্জন জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছে, বা তার বাপের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, অথবা এমন কোনো সমাবেশে যাচ্ছে যা কেবল নারীদের, অথবা গাড়ীতে করে মাসজিদে যাচ্ছে এবং মাসজিদের গেটে গাড়ী থেকে নেমে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত সলাতের জায়গায় অবস্থান করবে, যেটা পুরুষদের থেকে পুরোপুরি পৃথক এবং সলাত শেষে সোজা বেরিয়ে এসে গাড়ীতে উঠে পড়বে, যেখানে রাস্তার মাঝে হাঁটাহাঁটি করার দরকার পড়ে না- এই রকম অন্যান্য পরিস্থিতি যেখানে রাস্তায় হাঁটাচলা করার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং তার সুগন্ধি ব্যবহারের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা, তাহলে এসব ক্ষেত্রে তার জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা সাধারনভাবে শারিয়াহ্র দৃষ্টিকোন থেকে উৎসাহিত। এসকল ক্ষেত্রে তার সুগন্ধি ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। কারণ নারীদের সুগন্ধি ব্যবহারে যে নিষেধাজ্ঞা- যেটি হলো অন্য পুরুষে তার সুঘ্রাণ পেয়ে যেতে পারে- তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
উল্লিখিত মতের স্বপক্ষে দলিল হলো নিম্নরূপ:
(ক) উল্লিখিত হাদিসে নিষেধাজ্ঞার পেছনে যে সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে, এক্ষেত্রে সেই কারণ প্রযোজ্য নয়। কাজেই এক্ষেত্রে কোনো ফিতনা বা কোনো যৌন উসকানির তৈরি হয় না।
(খ) সুন্নাহ্ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পুরুষেরা সুঘ্রাণ পাবে না বলে মনে করলে মহিলা সাহাবীগণ সুগন্ধি লাগাতেন।
(খ) সুন্নাহ্ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পুরুষেরা সুঘ্রাণ পাবে না বলে মনে করলে মহিলা সাহাবীগণ সুগন্ধি লাগাতেন।
বর্ণনা করা হয় যে, ‘আয়েশাহ্ (রাঃ) বলেছেন: আমরা নাবী (ﷺ) এর সাথে মক্কায় যেতাম, এবং আমরা ইহ্রামে প্রবেশ করার সময় আমাদের কপালে সুগন্ধি লাগাতাম। তারপর আমাদের কেউ ঘেমে গেলে তা তার চেহারা দিয়ে গড়িয়ে পড়তো, এবং নাবী (ﷺ) এটা লক্ষ্য করতেন, কিন্তু তাকে বকুনি দিতেন না।
হাদিসটি আবূ দাঊদ (১৮৩০) বর্ণনা করেছেন এবং আন-নাওয়াবী আল-মাজমূ’ গ্রন্থে হাদিসটিকে হাসান এবং আল-আলবানি সহীহ্ আবি দাঊদে হাদিসটিকে সহীহ্ বলে রায় দিয়েছেন।
এই ব্যাপারটি বুঝতে হবে সেই সময়ের পরিস্থিতির আলোকে যখন নারীদের কাফেলা পুরুষের থেকে আলাদা থাকতো অথবা নারীরা তাদের হাওয়াদের মধ্যে থাকতো এবং তারা পুরুষদের মাঝে যেতো না বা তাদের অবস্থানের পাশ দিয়ে চলাফেরা করতো না।
শায়েখ ‘আব্দুল ‘আযীয ইবন বায (রহঃ) তার মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (১০/৪০) এর মধ্যে বলেছেন:
“নারীদের সমাবেশে গেলে এবং রাস্তায় পুরুষদের পাশ দিয়ে না গেলে তার জন্য সুগন্ধি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]
শায়েখ ইবন ‘ঊসাইমীন (রহঃ) এর জালাসাত রামাদানিয়্যাহ্ (১৪১৫/আল-মাজলিস আল-খামিস/মাজমু’আত আস’ইলাহ্ তুহিম্ম আল-উসরাহ্) এর মধ্যে বলা হয়েছে:
কিন্তু সে যদি গাড়ীতে চলে কোথাও যায় এবং তার সুঘ্রাণ কেবল তারাই অনুভব করতে পারে যাদের কাছে তার সুগন্ধির সুঘ্রাণ প্রকাশ পাওয়া বৈধ এবং সে গাড়ী থেকে নেমেই সোজা তার কর্মস্থলে চলে যায় যেখানে তার আশপাশে কোনো পুরুষ থাকে না, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এতে কোনো ক্ষতির বিষয় জড়িত নেই। তার গাড়ীর মধ্যে থাকা বাড়ীর মধ্যে থাকার মতোই। কিন্তু যদি সে কোনো পুরুষের পাশ দিয়ে চলাচল করে তাহলে সুগন্ধি লাগানো তার জন্য অনুমোদিত নয়। [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]
কোনো জরুরী পরিস্থিতি যেমন কোনো গাড়ী দুর্ঘটনা অথবা কোনো আকস্মিক অসুস্থতার কারণে কোনো নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বা এই রকম কিছু ঘটে যায় এবং কোনো পুরুষ তার সুগন্ধির সুঘ্রাণ পেয়ে যায়, তাহলে এসব ক্ষেত্রে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ্। কারণ আল্লাহ্ কোনো আত্মার উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেন না এবং শার’ঈ হুকুম সেসব ক্ষেত্রে মেনে চলতে হবে যেসব ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ পছন্দ করার অবকাশ থাকে, অপরিহার্যতার ক্ষেত্রগুলোতে নয়।
আল্লাহ্ রব্বুল ‘আলামীন সমস্ত বিষয়ে সর্বজ্ঞ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন