হাফিজ মা্ওলানা মুফতি মারুফের আক্বদে নিকাহ পড়িয়েছেন শাইখ সাইফুল ইসলাম।ব্যক্তিগত ভাবে কিছু পরিচয়ও আছে উনার সাথে। মুলাকাতের এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইলাম না। কমাশিসা বই হাতে দিলাম। তার আগে অবশ্য আক্বদে নিকাহএ চমতকার কিছু কথা রেখেছেন। মসিজেদর অফিসে বেশিক্ষণ বসা হলোনা তাড়া আছে । কারণ উনার মাদরাসা আল-মুমিন এ আক্বদে নিকাহ পরবর্তি মেহমানদারির আয়োজন করা হয়েছে সেখানে।
খাবার শেষে ফাঁকে ফাঁকে খুব ধীর গম্ভির কণ্ঠে আলাপচিরিতা জমে উঠলো। উনার হাতে প্রতিষ্ঠিত ছেলে এবং মেয়েদের জন্য বিশাল এই প্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখানোর জন্য ১২ বছরের এক কিশোরকে সাথে দিলেন। ছেলেটি খুব প্রাঞ্জল ভাষায় খুটে খুটে রুম গুলো দেখাচ্ছিলো আর দিচ্ছিলো তার বর্ণনা যে কোথায় কি হয়? এই বয়সে এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে দেখে অবাক হলাম। সে কিন্তু এই মাদরাসারই ছাত্র।
চার সন্তানের জনক মুফতি সাইফুল ইসলাম সাহেব জানালেন সবকটি সন্তান হাফিজে কুরআন।১০-১২ বছরের ভিতর সবাই হাফিজ ও হাফেজা।তাহফিজুল কুরআনের বিষয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে আলোকপাত করলাম। যে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬ ঘন্টা পড়া আর মাত্র ৮ ঘন্টা রেস্ট। দরজা গেইট বন্ধ করে তালা মেরে রুমে আটকিয়ে রেখে পড়ো নয়তো মরো এই হালত। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩ ঘন্টা এনাফ। আমি এবং আমার ছেলে মেয়েরা হাফিজ হয়েছি এভাবেই। স্কুল কলেজ ভাসির্টি মাদরাসার ক্লাসের পাশাপাশি এভাবেই বৈকালিক ক্লাসে বসে বসে ৩ বছরে হাফিজ হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। সকল লেখা পড়া বাদ দিয়ে কেবল হাফিজ বানানোর জন্য ফুলটাইম আলাদা ক্লাসের কোন প্রয়োজন নেই। পার্টটাইম যথেষ্ট। যারা হাফিজ হবে তাদের জন্য আলেম আলেমা হওয়া আবশ্যক। মেধা নেই জেহেন যাকাওয়াত নেই বছরের পর বছর এভাবে তাদের মুখস্থ করানোতে বাধ্য কারা কোন যুক্তি নেই। আমাদের মাদরাসায় পার্টটাইম হিফজ ক্লাস আছে। তারা স্কুলে পড়ে বিকালে এসে হিফজ ক্লাস। এই ক্লাসেও আমরা শুধু কুরআন মুখস্থ করাইনা সাথে আছে ফিকহ আক্বাইদ সহ জরুরী কিতাব সমূহ। এক পর্যায়ে তিনির বড় মেয়ের কথা বললেন যে, আমার মেয়ে ১২ বছর বয়সে হাফিজ হয়েছে। তার পাশাপাশি স্কুলের পড়ায় ও কুড়িয়েছে অসামান্য সুনাম।জিসিএসি ফাইনাল পরীক্ষায় ১১টি বিষয়ের ৯টিতে পেয়েছে গুল্ডেন এস্টার। মাদরাসার টাইটেল ক্লা্সের সমাপনী পরীক্ষায় হয়েছে মেধা তালিকায় প্রথম। ৭০জনের মত ছাত্রি ছিলো। যারা সমগ্র বৃটেনের সেরা।
মুফতি সাইফুল ইসলাম সাহেব খুব পরিস্কার ভাষায় জানান এভাবে জোর জবরদস্তি করে বন্দি অবস্থায় লেখা পড়া হয়না মেধার বিকাশ সম্ভব নয়। নাশাত থাকতে হবে। শিশু কিশোরদের জন্য হাশাশ বাশাশ পরিবেশ থাকা চাই্। একই বিষয় ক্রমাগত মুখস্থ তখন তাদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি সবক এবং পড়া থাকতে হবে আনন্দ দায়ক।
তিনি এক পর্যায়ে বললেন মওলানা চলুন আমার লাইব্রেরীতে। মানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। গাড়ি পার্ক করে দোকানে প্রবেশ করে দেখলাম কেশ বক্সের ভিতর সাইটে দাড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।চোখ বুলিয়ে পুরা দোকান দেখলাম। আসরের ওয়াক্ত লম্বা রাস্তায় কাজা হওয়া থেকে রক্ষা পেতে শুরুতে আদায় করতে জাগার তালাশি নিতেই বললেন উপরে সব ব্যবস্থা আছে চলে যান। আমরা তিনজন মুসাফিরের জন্য দুরাকাত নামাজ স্বল্প সময়ে আদায় করে নিলাম। দেখলাম উপরের তালায় ফতোয়া বোর্ড অফিস। এখানে বসেই তিনি শত শত মানুষের সেবা প্রদান করেন। জঠিল জঠিল বিষয় সমূহ ছাত্র সহকর্মীদের নিয়ে বসে সমাধান করেন।
নীচে এসে দেখলাম পিছনে আরেক রুম। কনসালটেনসি তথা পরামর্শ টেবিল। এখানে বসে প্রতিদিন আগত শত শত সাক্ষাত প্রার্থীর কথা শোনেন মশওয়ারা দেন। আক্বদে নিকাহ সহ যে কোন ব্যক্তিগত পারিবারিক পরামর্শ এখানেই হয়। শত শত মাইল দুর থেকে লোক এসে তিনির সাথে এখানেই সাক্ষাত করে। বিকাল তিনটা থেকে রাত সাতটা পর্যন্ত সাক্ষাতের সময়।
বল্লাম আমার মেয়েদের জন্য কিছু ইসলামি বই দরকার। বললেন সামনে আসুন। ডেস্কের সামনে সাজানো কিতাব দেখিয়ে বললেন এগুলোর পুরো একসেট নিতে পারেন। ইংরেজিতে আমার লিখা সকল বয়সের জন্য। আমি তাই করলাম। ভাল প্রাইসে দিছেন।
জিজ্ঞেস করলাম যে, হজরত কোন জিনিস আপনাকে ব্যবসায় নামালো? ফতোয়া মাদরাসা চাকুরি নকরি ইত্যাদি কি আপনার জন্য যথেষ্ট ছিলোনা? খুব স্পষ্ট করে বললেন ‘মাওলানা হালাল উপার্জন করা ফরজ ইবাদত সমূহের পর আরেক ইবাদত। আমি এখানে বসে হালাল বিজনেস যেমন করছি তেমনি শত শত মানুষের সাথে সাক্ষাত ও হচ্ছে। তাদের সাথে মত বিনীময়ও হচ্ছে। সাহাবা তাবেঈন বড় বড় মুহাদ্দিসীন গণের ইতিহাস ঘাটলে আমরা এর নজির পাই। উলামারা যদি সুদমুক্ত ব্যবসা করে উপমা পেশ না করেন তাহলে সাধারণ জনগণ তা শিখবে কো্ত্থেকে?’
আমি একজন হাফিজে কুরআন আলেমেদ্বীন মুহাদ্দিস আল-মুমিন স্কুল এন্ড মাদরাসার প্রতিষ্টাতা হাজার হাজার যুবক যুবতি যার নসিহা শুনতে পাগল পারা। তিনির দোকানদারি দেখে অভিভুত না হয়ে পারলামনা।
শোনলাম তিনির জিপি বা পার্সোনাল ডাক্তার তিনিরই ছাত্র। বৃটিশ এয়ারওয়েজর প্লেনের ডিজাইনার তিনির ছাত্র। প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার ডক্টর পাকিস্তানি বাংলাদেশি আরাবিয়ান ইউরোপিয়ান আমেরিকান শাদা কালো বাদামি সকল শ্রেণীর মানুষ তাকে প্রাণ খোলে ভালবাসে। বললনে নিজের রুজি ও কামাই থেকে হামেশা জরুরত আসলে প্রথম চাঁদা তিনি দেন তৌফিক মতো।
একদিনের ঘটনা বললেন যে, সরকারি হাইস্কুলে ছাত্রদের মাঝে এমন হাংগামা শুরু হলো যা থামানো কঠিন হয়ে পড়লো কর্তৃপেক্ষের উপর। শিক্ষক অভিভাবক সবাই চিন্তিত আতংকিত। এমনি পরিস্থিতিতে কে যেন তাকে আনার পরামর্শ দিলো। কারণ বাংগালি পাকিস্তানি শাদা কালো ইত্যাদি নিয়ে চলছিলো ছাত্রদের মাঝে হিংসাত্মক বিরোধ। তিনি গেলেন বয়ান দিলেন, বললেন তোমরা আমরা কি এক আদমের সন্তান নই?… কালো ধলো কার বানানো?… মানুষের ডিজাইন যিনি তৈরী করেছেন বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তার দোষ নাকি যাকে বানানো হয়েছে তার অপরাধ? তোমারআ কাকে ভাল মন্দ বলবে? সেই থেকে মারা মারি বন্ধ। শাদা চামড়ার লোকগুলো শ্রদ্ধায় নত হয়ে পড়ে। তারা এখনো ঘুরের মাঝে যে কি রহস্য এই মুফতির মাঝে! আজও ছাত্ররা হট্টগুল করলে শিক্ষকরা বলে আমরা কি মুফতি কে ডাকবো?
আমি বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার কথা বললাম। কমাশিসার কথা আলাপ হলো। বললেন বড়ই দুর্ভাগ্য যে তাদের বুঝাতে পারিনা।আপনাদের উদ্যোগ আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সম্বয় না হলে প্রজন্ম একদিকে হবে ধর্ম বিমূখ অন্যদিকে কর্মবিমুখ। দুটোই আমাদের বিপদ। তাই সমন্বয় খুবই জরুরী।
আগামি ১৭ জানুয়ারী ২০১৬ লন্ডন একটি কন্ফারেন্সের জন্য দাওয়াত কবুল করেছেন। আশা করছি তখন সচেতন উলামাবৃন্দকে নিয়ে প্রানবন্ত একটি মাহফিল আয়োজন করতে পারবো। তাই আসুন মুফতি সাইফুল ইসলামের মতো যোগ্য বিচক্ষণ মেধাবী আমলদার ফক্বীহ উলামাদের সান্নিধ্য গ্রহন করে তাদের পরামর্শ নিয়ে নিজে উপকৃত হই উম্মাহকে আলোকিত করি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন