বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৫

রাসূল (সা) বলেছেন, “ইয়া আল্লাহ! এই পরিবারকে জান্নাতে আমার সহচর বানিয়ে দাও।

খাতুনে উহুদ হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)। ইসলামের ইতিহাসে তিনি “খাতুনে উহুদ” বলে খ্যাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহান মহিলা সাহাবী ছিলেন হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)। তাঁর প্রকৃত নাম “নুসাইবাহ বিনতে কা’ব” কিন্তু ইতিহাসে তিনি নিজের কুনিয়াতেই খ্যাত হয়ে আছেন। তিনি আনসারের খাজরাজ গোত্রের প্রখ্যাত বনু নাজ্জার গোত্রের। নসবনামা হল-নুসাইবাহ বিনতে কা’ব বিন আমর বিন আওফ বিন আবজুল বিন আমর বিন গানাম বিন মাযন বিন নাজ্জার। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)-এর প্রথম বিয়ে হয়েছিল চাচাতো ভাই যায়েদ বিন কাসেমের সঙ্গে। যায়েদের ঔরসে তাঁর দুটি সন্তান হয়েছিল। তাঁদের নাম হল-আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) এবং হাব্বি (রাঃ)। এই দুই ভাই সাহাবী ছিলেন এবং ইতিহাসখ্যাত হয়েছিলেন। যায়েদের ওফাতের পর হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)-এর বিয়ে হয়েছিল আরবাহ (রাঃ) বিন আমরের সঙ্গে। তাঁর ঔরসে তামিম ও খাওলাহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) আনসারের সাবিকিনা আওয়ালিনার মধ্যে পরিগণিত। প্রথম বাইয়াতে আকাবার পর যখন হযরত মুসয়াব বিন উমাইর (রা) মদিনায় ইসলামের প্রচার করছিলেন তখন তিনি পরিবারসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর নবুয়তের ১৩তম বছরে তিনি সেই ৭৫ জনের অন্তর্ভুক্ত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন যারা আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াত করেছিলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার তাশরীফ নিলে জান, মাল এবং সন্তানসহ তাঁকে সমর্থন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের তৃতীয় বছরে উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) যুদ্ধে অংশ নেন এবং এমন বীরত্ব, দৃঢ়তা ও অটলতা প্রদর্শন করেন যে, ইতিহাসে তিনি “খাতুনে উহুদ” উপাধিতে খ্যাত হন। তাবাকাতে ইবনে সাদের রাওয়াতে অনুযায়ী তাঁর স্বামী আবরাহ (রাঃ) বিন আমর, দুই পুত্র আব্দুল্লাহ (রাঃ) এবং হাব্বিও (রাঃ) উহুদের যুদ্ধে তাঁর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন।
যুদ্ধে যখন মুসলমানরা অগ্রগামী ছিলেন তখন উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) অন্য মহিলাদের সাথে মশকে পানি ভরে ভরে মুজাহিদদেরকে পান এবং আহতদেরকে সেবা করতেন। যখন একটি ভুলের কারণে যুদ্ধের দৃশ্য বদলে গেল এবং মুজাহিদরা বিশৃংখলার শিকার হলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন জীবন উৎসর্গকারী রয়ে গেলেন। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে মশক ফেলে দিয়ে তরবারী এবং ঢাল হাতে তুলে নিলেন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পৌঁছে কাফেরদের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাফেররা বার বার হামলা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে অগ্রসর হতো এবং উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) তাদেরকে অন্যান্য অটল সাহাবীর (রাঃ) সঙ্গে একত্রিত হয়ে তীর ও তরবারী দিয়ে বাধা দিতেন। এটা বড় ভয়ানক সমর ছিল। ইত্যবসরে এক মুশরিক তাঁর মাথার ওপর পৌঁছে তরবারী চালিয়ে দিল। উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) তাকে নিজের ঢাল দিয়ে প্রতিরোধ করলেন এবং তার ঘোড়ার পায়ের ওপর তরবারীর এমন আঘাত হানলেন যে, ঘোড়া এবং সওয়ার উভয়েই মাটিতে পতিত হলো। সারওয়ারে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এই চিত্র দেখছিলেন। তিনি উম্মে আম্মারাহর পুত্র আব্দুল্লাহকে ডেকে বললেন, ‘আব্দুল্লাহ! তোমার মাকে সাহায্য কর।’ তিনি তৎক্ষণাৎ সেদিকে এগিয়ে গেলেন এবং তরবারীর এক আঘাতেই সেই মুশরিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। ঠিক সেই সময় অন্য একজন মুশরিক দ্রুত সেদিকে এলো এবং হযরত আব্দুল্লাহর (রাঃ) বাম বাহুতে আঘাত করে চলে গেল।
হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) স্বহস্তে আব্দুল্লাহর ক্ষতস্থান বাঁধলেন এবং বললেন-পুত্র! যাও এবং যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ লড়াই কর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবন উৎসর্গের আবেগ দেখে বললেন-হে উম্মে আম্মারাহ্! তোমার মধ্যে যে সাহস রয়েছে আর কার মধ্যে থাকবে? ঠিক এই সময় আব্দুল্লাহকে আঘাতকারী মুশরিক ফিরে আবার হামলা করে বসলো। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে আম্মারাহকে (রাঃ) বললেন-উম্মে আম্মারাহ। ঠেকানো চাই। এ সেই হতভাগা যে আব্দুল্লাহকে আহত করেছিলো। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) ক্রোধান্বিত হয়ে তার দিকে অগ্রসর হলেন এবং তরবারীর এমন আঘাত হানলেন যে, সে দুই টুকরো হয়ে নিচে পড়ে গেল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দৃশ্য দেখে মুচকি হাসি দিলেন এবং বললেন-উম্মে আম্মারাহ! তুমি পুত্রের খুব প্রতিশোধ নিয়েছ। (দ্রঃ মজিলা সাহাবী;তালিবুল হাশেমী, পৃঃ ৩১৫-৩১৬)।
এই সময় ইবনে কামিয়া যখন সকল বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে এগিয়ে আসছিলো, তখন তার অগ্রগামিতাকে রুখে দাঁড়ান হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)। তাতে তিনি কাঁধে আঘাত পান। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)ও তার প্রতি তলোয়ারের শক্তিশালী আঘাত হেনেছিলেন, কিন্তু তার পায়ে দ্বিগুণ বর্ম থাকায় তলোয়ারের কোপ কার্যকরী হয়নি। (ইবনে হিশাম, পৃঃ ৮৪)।
ইবনে কামিয়ার আঘাতের কারণে হযরত উম্মে আম্মারাহ্ (রাঃ)-এর কাঁধে গর্ত হয়ে গিয়েছিলো। সেই ক্ষতস্থান থেকে দরদর করে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তাঁর ক্ষতস্থানে পট্টি বাঁধলেন এবং কয়েকজন বাহাদুর সাহাবীর (রাঃ) নাম উচ্চারণ করে বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আজ উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) তাদের সবার চেয়ে বেশি বাহাদুরী প্রদর্শন করেছেন।” হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) আরজ করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল! আমার মাতা-পিতা আপনার ওপর কুরবান হোক। আমার জন্য দোয়া করুন যাতে জান্নাতেও আপনার সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত একাগ্রতার সাথে তার জন্য দোয়া করলেন এবং উচ্চৈস্বরে বললেনঃ “আল্লাহুম্মা আজরালহুম রিফকায়ি ফিল জান্নাতি”। হযরত উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) খুব খুশী হলেন এবং তাঁর মুখ দিয়ে অযাচিতভাবে এই বাক্য উচ্চারিত হল-“ এখন আর আমার এই দুনিয়ায় মুসিবতের কোনও পরওয়া নেই।” যুদ্ধ শেষ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উম্মে আম্মারাহর (রাঃ) অবস্থা না জানা পর্যন্ত বাড়ী ফিরে যাননি। হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) বিন কা’ব মাযনীকে পাঠিয়ে তার খবর নেন। তারপর বাড়ী যান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন- উহুদের দিন ডানে-বামে যেদিকেই নজর দিতাম, শুধু উম্মে আম্মারাহ (রাঃ)কে লড়াই করতে দেখতাম। (তালিবুল হাশেমী পৃঃ ৩১৭)।
আল্লামা ইবনে সাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন, উহুদের যুদ্ধের পর তিনি বাইয়াতে রিদওয়ান, খায়বারের যুদ্ধ, উমরাতুল কাজা এবং হুনাইনের যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। অন্য আরেক রেওয়ায়েত অনুযায়ী তিনি মক্কা বিজয়ের সময়ও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গী ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে সংঘটিত ভণ্ড নবী মুসায়লামাহ কাজ্জাবের বিরুদ্ধে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই যুদ্ধে মুসায়লামাহ ধ্বংস হয়।
হযরত উম্মে আম্মারাহর (রাঃ) ইন্তেকাল সাল সম্পর্কে জানা যায়নি। অবশ্য কতিপয় রেওয়ায়েত অনুযায়ী তিনি হযরত ওমর ফারুকের (রাঃ) খিলাফতকালে জীবিত ছিলেন এবং সেই আমলেই ইন্তেকাল করেন। হযরত উম্মে আম্মারাহ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে অপরিসীম মহব্বত করতেন, উহুদের ময়দানে তার বাস্তবচিত্র পাওয়া যায়। আরো অনেক ঘটনা আছে। একবার আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গৃহে তাশরীফ নিলেন। তাঁকে কিছু খেতে দিলেন। তিনি বললেন, “আপনি কিছু খান।” তিনি জবাবে বললেন, “আমি রোযাদার”। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেয়ে নিলেন এবং ইরশাদ করলেন, “রোযাদারের সামনে কিছু খাওয়া হলে ফিরিশতাগণ তার প্রতি দরূদ পাঠান”। (মুসনদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খন্ড,পৃঃ ৩৬৫) উম্মে আম্মারাহ (রাঃ) কতিপয় হাদীস বর্ননা করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন