কিছু লামাযাহাবী ভাইদেরকে বলতে শুনা যায় যে, আলেমদের নামের পূর্বে “মাওলানা” শব্দ ব্যবহার করা সঠিক নয়। আবার কেউ বা বাড়িয়ে বলেন, আলেমদের নামের পূর্বে “মাওলানা” শব্দ ব্যবহার করা শিরক !!! এসব ভাইদের ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমীন।]
“মাওলা” শব্দটি আসমাউল হুসনার অর্ন্তভুক্ত। তাই নিম্নে আসমাউল হুসনা সম্পর্কে শরীয়াতের নীতিমালা উল্লেখ করা হল -
আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম দুই ধরণের-
প্রথমত.
যে সকল নাম শুধু আল্লাহ তাআলার সাথে সুনির্দিষ্ট। যেমন,الله,الرحمن, الخالق, البارى, القيوم ইত্যাদি শব্দে অন্যদেরকে নাম রাখা জায়েজ নয়। কেননা আল্লাহ তাআলার মু‘ছাম্মা তথা নামীয় সুনির্দিষ্ট।যা অংশিদারিত্বকে গ্রহণ করে না।
দ্বিতীয়ত.
যে সকল নামের ব্যাপক অর্থ রয়েছে। অবস্থাভেদে যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন, মালিক, আযীয, জাব্বার,মুতাকাব্বির ইত্যাদি শব্দ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে ও ব্যাবহার করা জায়েজ আছে। এ সকল শব্দ আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে কোথাও নিজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন আবার কোথাও বা বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। নিম্নের উদাহরণ গুলোর প্রতি লক্ষ করলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ -
১.
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন -إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ অর্থাৎ“নিশ্চয়ই তিনি সকল কথা শোনেন, সকল কিছু জানেন।” (সুরা আনফাল-৬১)।
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে عَلِيمُ (তথা সব জান্তা) শব্দ ব্যবহার করেছেন আবার নি¤েœাক্ত আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও عَلِيمُশব্দ ব্যবহার করেছেন।
ইরশাদে রব্বানী -وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ অর্থাৎ“অতঃপর তারা তাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দিল যে, বড় জ্ঞানী হবে।” (সুরা যারিআত আয়াত নং-২৮) আয়াতে ইসহাক আ.এর ঘটনার দিকে ইংগিত করা হয়েছে। তবে এটি সুস্পষ্ট বিষয় যে,আল্লাহ তাআলার ইলম আর বান্দার ইলমের মাঝে রয়েছে বিশাল ব্যাবধান ও পার্থক্য। আল্লাহ তাআলার ইলম হচ্ছে পুর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ। আদিতেই তার ইলম ছিল কখনো অজ্ঞতা ছিল না। আর তিনি কখনো বিষ্মৃত হন না এবং তার ইলমে কখনো কমতি ও ত্রুটি দেখা দেয় না। এর বিপরীত হলো মানুষের ইলম, কেননা তা ত্রুটিযুক্ত। মানুষের ইলমের আগের অবস্থা হলো অজ্ঞতা ও মূর্খতা । আর মানুষদেরকে যে জ্ঞান দান করা হয়েছে তা স্বল্পই।
২.
আল্লাহ তাআলার বাণী-.الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُঅর্থাৎ“ আল্লাহ তাআলা মহা ক্ষমতাবান,মহা প্রতাপশালী, গৌরান্বিত।” (সূরা হাশর-২৩) উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে “আযীয” শব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার সুরা ইউসূফে (আয়াত নং-৫১) বান্দার ক্ষেত্রেও “আযীয” শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
قَالَتِ امْرَأَةُ الْعَزِيزِ الآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ অর্থাৎ “আযীয়ের স্ত্রী বলল, এবার সত্য কথা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।”
অন্য আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও ْجَبَّارও مُتَكَبِّر শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَى كُلِّ قَلْبِ مُتَكَبِّرٍجَبَّارٍٍঅর্থাৎ“এভাবেই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির অন্তরে মোহর করে দেন।” (সূরা মুমিন-৩৫)
৩.
আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে حَلِيم শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ইরশাদে রব্বানী إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا অর্থাৎ“তিনি সহনশীল, ক্ষমাশীল।” (সূরা ফাতির-৪১)।
আবার বান্দার ক্ষেত্রেও حَلِيمশব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন, ইরশাদ হয়েছে- فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ অর্থাৎ“সুতরাং, আমি তাকে (ঈসমাইল আ. কে) এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।” (সুরা আস-সফ্ফাত-১০১)
৪.
ইরশাদে রব্বানী إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا অর্থাৎ“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।” (সূরা নিসা -৫৮)
উক্ত আয়াতে করীমায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে سَمِيعًও بَصِيرশব্দ ব্যবহার করেছেন। আবার সূরা দাহ্রের ২ নং আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রে ও উক্ত শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। ইরশাদ হয়েছে – إِنَّا خَلَقْنَا الإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا অর্থাৎ আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্র হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। তারপর তাকে এমন বানিয়েছি যে, সে শোনেও দেখেও।
৫.
আল্লাহ তাআলা নিজের ব্যাপারে الْمَلِكُশব্দ ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর বাণী الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) বাদশাহ পবিত্রতার অধিকারী (সূরা হাশর-২৩)। আবার বান্দার ক্ষেত্রেও উক্ত শব্দ ব্যবহার করেছেন। ই্রশাদ হয়েছেَكَانَ وَرَاءَهُمْ مَلِكٌ يَأْخُذُ كُلَّ سَفِينَةٍ غَصْبًا অর্থাৎ (কেননা) তাদের সামনে ছিল এক রাজা। যে বলপ্রয়োগে সব (ভালো) নৌকা কেড়ে নিত। (সুরা কাহ্ফ-৭৯)
৬.
ইরশাদে রব্বানী إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ অর্থাৎ“বস্তুত আল্লাহ মানুষের প্রতি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু।” (সুরা বাকারা-১৪৩)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে َرَءُوفٌও رَحِيمٌ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়েছে।আবার নিম্নোক্ত আয়াতে বান্দার ক্ষেত্রেও উক্ত শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ অর্থাৎ“হে মানুষ, তোমাদের কাছে এমন এক রাসূল এসছে যে, তোমাদের নিজেরদেরই লোক। তোমাদের যে কোনও কষ্ট তার জন্য অতি পীড়দায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণ কামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ,দয়াময়।”(সুরা তাওবা-১২৮)
৭.
মহব্বত শব্দটি আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, আবার বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। ইরশাদ হয়েছে. فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ অর্থাৎ “অচিরে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাকে ভালবাসবে।”(সূরা মায়েদা -৫৪)।
৮.
অনুরূপভাবে “রিযা” শব্দটি নিজের জন্য এবং বান্দার জন্য ব্যবহার করেছেন।অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ অর্থাৎ“ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সুরা বাইয়্যিনাহ-৮) ।
উপরোক্ত এ সকল আয়াতে কারীমায় যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হল তা হচ্ছে ১.একই শব্দ আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রেও ব্যাবহার হয়েছে আবার বান্দার ক্ষেত্রেও ব্যাবহার হয়েছে।২.
আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে যে অর্থে ব্যাবহার হয়েছে আর বান্দার ক্ষেত্রে যে অর্থে ব্যাবহার করা হয়েছে উভয়ের মাঝে রয়েছে মর্মার্থের দিক দিয়ে বিশাল পার্থক্য। বিষয়টি আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আব্দুর রাজ্জাক বিন আব্দুল মুহসিন আল বদ্র লিখিত ‘ফিকহুল আসমাইল হুসনা’ গ্রন্থটি। মাওলা বা মাওলানা শব্দের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই ঘটেছে।
কুরআন মাজীদে “মাওলা” এবং “মাওলানা” শব্দের ব্যবহার
কুরআন মাজীদে “মাওলা” এবং “মাওলানা” শব্দটি বিভিন্ন অর্থে এসেছে। নি¤েœ তা উল্লেখ করা হলো-
সঙ্গী, অনুসারী ও সাহায্যকারী অর্থে
১. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-وَإِنْ تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ
অর্থাৎ“কিন্তু তোমরা নবী (পত্নীগণ) যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে (জেনে রেখ) তাঁর সঙ্গী আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ। তাছাড়া ফিরিশতাগণ তার সাহায্যকারী।” (সূরা তাহরীম-আয়াত নং-৪)
তাফসীরে বায়যাবীতে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বালা হয়েছে
فلن يعدم من يظاهره من الله والملائكة وصلحاء المؤمنين فإن الله ناصره وجبريل ريئس الكروبيين قرينه ومن صلح من المؤمنين أتباعه وأعوانه
অর্থাৎ তাঁর সাহায্যকারীরা তথা আল্লাহ, ফিরিশতা এবং নেককার মু’মিনগণ সর্বদা তাকে সাহায্য করবে। কেনা আল্লাহ হলেন তার সাহায্যকারী আর মর্যাদাবান ফিরিশতাদের সরদার জিবরাঈল হলেন তাঁর সহচর। আর নেককার মু’মিন বান্দারা হলেন তাঁর অনুসারী ও সাহায্যকারী।
তাফসীরে রুহুল মা’য়ানীতে (২৮/৪৬৪,৪৬৫) বলা হয়েছে-
فإن الله هو مولاه أي ناصره ..وجبريل مولاه أي قرينه وصالح المؤمنين مولاه أي تابعه
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা নবীজীর ‘মাওলা’ তথা তার সাহায্যকারী। জিবরাঈল আ: নবীজীর ‘মাওলা’ তথা তাঁর সাথী। আর সৎকর্মশীল মুমিনগণ নবীজীর ‘মাওলা’ তথা তাঁর অনুসরণকারী।
অভিভাবক, হিতৈষী বন্ধু ও সাহায্যকারী অর্থে
২.
ইরশাদ হয়েছে-أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الأَرْضِ فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ دَمَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلِلْكَافِرِينَ أَمْثَالُهَا অর্থাৎ “তারা কি পৃথিবীতে পরিভ্রমন করেনি এবং দেখেনি তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে? আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেছেন এবং কাফেরদের জন্য রয়েছে অনুরূপ পরিণাম।”
ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ مَوْلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَأَنَّ الْكَافِرِينَ لَامَوْلَى لَهُمْ
“তা এজন্য যে, আল্লাহ তো মুমিনদের অভিভাবক/হিতৈষী বন্ধু এবং কাফেরদের তো কোন অভিভাবক/হিতৈষী বন্ধু নেই।” (সুরা মুহাম্মাদ আয়াত নং- ১০, ১১) ।
ব্যাখ্যা: এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আলুছী রহ. বলেন, بِأَنَّ اللَّهَ مَوْلَى الَّذِينَ آمَنُوا أي ناصرهم على أعدائهم অর্থাৎ “আল্লাহ তাআলা মুমিনদের (ঈমানের কারণে) তাদের শত্রুদের মোকাবিলায় বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিণভাবে সাহায্যকারী”। (রুহুল মা‘আনী দারুল হাদীস ২৬/২৭৩,২৭৪)
মালিক ও অভিভাবক অর্থে
৩. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
هُنَالِكَ تَبْلُو كُلُّ نَفْسٍ مَا أَسْلَفَتْ وَرُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ
“সেদিন তাদের প্রত্যেকে তার পূর্বকৃত কর্ম সম্বন্ধে অবহিত হবে এবং সকলকেই তাদের প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তারা যে মিথ্যা রচনা করেছিল, তার কোন সন্ধান তারা পাবে না।” (সূরা ইউনূস-৩০)
ব্যাখ্যা:উক্ত আয়াতের وَرُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ এর ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহ. বলেন, أي: ورجعت الأمور كلها إلى الله الحكم العدل، ففصلها، وأدخل أهل الجنة الجنة، وأهل النار النار. অর্থাৎ সকল বিষয়ই আল্লাহর কাছে- যিনি মহান ন্যায় বিচারক- প্রত্যার্পিত হবে। তিনি ন্যায় মুতাবেক বিচার করে জান্নাত বাসীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন আর দোযখের উপযুক্ত ব্যক্তিদের দোযখে দাখিল করাবেন।(ইবনে কাসির ২/৪১৪, দারুল মানার )।
ব্যাখ্যা:ইমাম আবু মুহাম্মাদ আল হুসাইন ইবনে মাসউদ আল বাগাবী রহ. (৫১৬হি.) বলেন,
الذي يتولى ويملك أمرهم: فإن قيل: أليس قد قال: ” وأن الكافرين لا مولى لهم “؟ قيل: المولى هناك هو الناصر، وههنا بمعنى: المالك،
অর্থাৎ যিনি তাদের সব বিষয়ের তত্বাবধায়ক ও প্রকৃত মালিক। যদি প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তাআলা কি বলেন নি কাফেরদের কোন অভিভাবক নেই?। (সূরা মুহাম্মাদ-১১) উত্তরে বলা হবে সূরা মুহাম্মাদে মাওলা শব্দটি সাহায্যকারী অর্থে এসেছে। আর এখানে এসেছে মালিক অর্থে। [অতএব কোন বৈপরিত্য থাকল না ।] (মাআলিমুত তানযীল ২/৩৫২ দারুল মা’রেফা, বৈরুত)
ব্যাখ্যা:ইমাম আবু হায়্যান আল উন্দুলুসী র. তার তাফসীরে আল বাহরুল মুহীত, (৫/২০০, দারু এহইয়াইত তুরাসিল আরাবী ) বলেছেন-
مولاهم الحق ، لا ما زعموه من أصنامهم ، إذ هو المتولي حسابهم. فهو مولاهم في الملك والإحاطة ، لا في النصر والرحمة
অর্থাৎ তাদেরকে তাদের প্রকৃত অভিভাবকের নিকট ফিরিয়ে আনা হবে। তাদের ধারণা প্রসূত অভিভাবক তথা মূর্তির নিকট নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা তাদের হিসাব গ্রহণকারী । অতএব কর্তৃত্ব ও পরিবেষ্টনের দিক দিয়ে তিনি তাদের মাওলা। সাহায্য ও রহমতের দিক বিচারে নয়।
স্বজন ও আসাবা অর্থে
৪.
ইরশাদ হয়েছে -وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَائِي وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا فَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا
অর্থাৎ (হযরত যাকারিয়া আ. দোয়া করেন) “আমি আমার পরে স্বজনদের ভয় করি।আমার স্ত্রী বন্ধ্যা ।সুতরাং তুমি তোমার নিকট হতে আমাকে দান কর উত্তারাধীকারী।” (সূরা মারিয়ম-৫)
১
অর্থাৎ তার আত্বীয় স্বজন অযোগ্য হয়ে থাকবে। তাই আশংকা করেছিলেন, তাঁর ইন্তেকালের পর তারা অন্যায় অসৎ কর্মে লিপ্ত হয়ে সত্য -সরল পথকে বিগড়িয়ে না ফেলে এবং পুরাষানুক্রমে যে দ্বীনী ও আধ্যাত্বিক সম্পদ ইয়াকুব আ. এ খান্দান হতে বদল হতে হতে যাকারিয়া আ. পর্যন্ত এসে পৌছেছে তা নিজেদের দুষ্কর্ম ও অসদাচারণের কারনে খুইয়ে না বসে। (তাফসীরে উসমানী)
২।
এ আয়াতের আরেকটি তরজমা হল আমি আমার পর আমার চাচাত ভাইদের ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করছি এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা।
অর্থাৎ আমার নিজেরতো কোন সন্তান নেই। আবার আমার চাচত ভাইয়েরাও জ্ঞান গরিমা ও তাকওয়া ফরহেযগারীতে এ পর্যায়ে নয় যে, তারা আমার মিশন অব্যহত রাখবে। তারা দ্বীনের খেদমতকতটুকু আঞ্জাম দিতে পারবে সে ব্যপারে আমার যথেষ্ঠ ভয়। সুতরাং আমার নবুওয়াতী ইলমের উত্তরাধিকারী হতে পারে এমন এক পুত্র সন্তান আমাকে দান করুন। (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন)।
ব্যাখ্যা:হাফেজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর রহ. (৭০০-৭৭৪ হি.) তার তাফসীরে ইবনে কাসীরে (৩/১১১, দারুল মানার ) উক্ত الْمَوَالِيَ শব্দের ব্যাখ্যাায় লিখেন-
قال مجاهد، وقتادة، والسدي: أراد بالموالي العصبة. وقال أبو صالح: الكلالة.
অর্থাৎ মুজাহিদ, কাতাদা, এবং সুদ্দী বলেন, মাওয়ালী দ্বারা উদ্দেশ্য আসাবা আর আবু সালেহ বলেন,এর দ্বারা কালালা তথা নিঃসন্তান ও পিতৃহীন উদ্দেশ্য ।
ব্যাখ্যা:তাফসীরে রুহুল মাআনীতে (১৬/৫৩৪ দারুল হাদীস) বলা হয়েছে-
هم عصبة الرجل على ما روي عن ابن عباس رضي الله تعالى عنهما ومجاهد وعن الأصم أنهم بنو العم وهم الذين يلونه في النسب وقيل : من يلي أمره من ذوي قرابته مطلقا.
অর্থঃ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ থেকে বর্ণিত মত অনুযায়ী মাওয়ালী হল(যাকারিয়া আঃ) এর আসাবা। আর আসাম থেকে বর্ণিত মত অনুযায়ী তারা হলো তাঁর পিতৃব্য পুত্র, তথা তাঁর বংশের নিকটতম ব্যক্তিরা। কারো কারো মতে যেসব নিকটাত্মীয় তাঁর কর্তৃত্বাধিকারী হবে সাধারনভাবে (তারাই উদ্দেশ্য)
বন্ধু ও মিত্র অর্থে
৫.
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ ঃ يَوْمَ لَا يُغْنِي مَوْلًى عَنْ مَوْلًى شَيْئًا وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ
অর্থাৎ ঃ “যেদিন এক বন্ধু অপর বন্ধুর সামন্য উপকারেও আসবে না এবং তারা সাহায্যও পাবে না।” (সূরা দুখান, আয়াত-৪১)
ব্যাখ্যা: উক্ত আয়াতের মাওলা শব্দের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসী রহ. বলেন
والمولى الصاحب الذى من شانه ان يتولى معونةصاحبه على أموره فيدخل فى ذلك ابن العم والحليف والعتيق والمعتق وغيرهم-
অর্থাৎ মাওলা ঐ সাথী ও বন্ধু যার কাজ হলো তার বন্ধুর কাজে সহায়তা করা। অতএব মাওলা এর মাঝে পিতৃব্য পুত্র, কোন বিশেষ অঙ্গীকারাবদ্ধ বন্ধু, আযাদকৃত গোলাম, ও আযাদকারী ইত্যাদি ব্যক্তি অর্šÍভুক্ত। (রুহুল মাআনী ২৫/১৭৬ দারুল হাদীস)
ব্যাখ্যা: তাফসীরে কাবীরে (২৭/২২২ আল মাকতাবাতুত তাওফীকিইয়াহ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. (৫৫৪-৬০৪ হি.) লিখেছেন
والمعنى ان الذى يتوقع منه النصرة اماالقريب فى الدين أوفى النسب أوالمعتق, وكل هؤلاء يسمون بالمولى, فلمالم تحصل النصرةمنهم فبأن لاتحصل ممن سواهم أولى.
অর্থাৎ “যার থেকে সাহায্যের আশা করা যায়। চাই সে দ্বীন,বংশ কিংবা আযাদকারী ইত্যাদি দিক থেকে নিকটস্থ হোক না কেন।এদের সকলকে মাওলা বলা হয়। যখন এদের থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে না তখন অন্যদের থেকেও না পাওয়াই অধিকতর উপযোগী বা যুক্তিযুক্ত”। এছাড়া সূরা আহযাবের ৫ নং আয়াতে “মাওলা” শব্দটি বন্ধু অর্থে এসেছে।
মালিক ও তত্বাবধায়ক অর্থে
৬.
আল্লাহতাআলার বাণী -
قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ وَاللَّهُ مَوْلَاكُمْ وَهُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ
অর্থাৎ ঃ আল্লাহ তোমাদেরকে কসম থেকে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা দান করেছেন। আল্লাহ তোমাদের কর্মবিধায়ক বা মালিক। তিনিই সর্বজ্ঞ, পরিপূর্ণ হেকমতের মালিক। (সূরা তাহরীম,আয়াত-২)
ব্যাখ্যা:তাফসীরে বায়যাবীতে (৫/৩৫৫ দারুল ফিকর, বায়রুত, লেবানন)والله مولكمএর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে متولى أمركم অর্থাৎ তিনি তোমাদের বিষয়ের তত্বাবধায়ক।
ব্যাখ্যা:আর তাফসীরে তাবারীতে (১২/১৫১ পৃ. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)বলা হয়েছে, يتولاكم بنصره أيهاالمؤمنونঅর্থাৎ হে মুমিনগণ তিনি তোমাদেরকে সাহায্যের দ্বারা তত্ত্বাবধান করেন (অর্থাৎসাহায্য করেন)।
ব্যাখ্যা: ইমাম বাগাবী রহ. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন وليكم وناصركم অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক এবং সাহায্যকারী। (তাফসীরে বাগাবী ৪/৩৬৩ পৃ. দারুল মা’রিফা বায়রুত )
অভিভাবক ও সর্বময় কর্তা অর্থে
৭.
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
অর্থাৎ ঃ হে আমাদের প্রতিপালক! এমন ভার আমাদের উপর করো না যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন কর, আমাদেরকে ক্ষমা কর, আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমি আমাদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী, কাজেই কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর।(সূরা বাকারাহ-২৮৬)
ব্যাখ্যা:তাফসীরে রুহুল মাআনীতে (৩/৯৬ দারুল হাদীস) انت مولاناএর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে اى مالكناوسيدنا, وجوز ان يكون بمعنى متولى الأمرঅর্থাৎ তুমি আমাদের একচ্ছত্র অধিপতি এবং আমাদের সর্দার। এখানে مولانا দ্বারা সর্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধানকারী ও পরিচালনকারী অর্থ গ্রহণের ও অবকাশ রয়েছে।
ব্যাখ্যা: আল্লামা ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর রহ. বলেন وقوله انت مولاناأى انت وليناوناصرناঅর্থ ঃ انت مولاناঅর্থাৎ তুমি আমাদের সর্বময় কর্তা এবং আমাদের সাহায্যকারী (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৩২৯ দারুল মানার)
এ ছাড়াও সূরা তাওবার ৫১ নং আয়াত ও সূরা হাজ্জের ৭৮ নং আয়াতে “মাওলা” শব্দটি অভিভাবক অর্থে এসেছে।
মুনিব অর্থে
৮.
ইরশাদে রব্বানী-
وضرب الله مثلارجلين احدهماابكم لايقدرعلى شيئ وهوكل على موله, اينما يوجهه لايأت بخير, هل يستوى هوومن يأمربالعدل وهوعلى صراط مستقيم-
অর্থাৎ ঃ আল্লাহ আরেকটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন- দু’জন লোক, একজন বোবা, কোন কাজ করতে পারে না এবং সে তার মুনিবের জন্য একটা বোঝা, যেদিকেই তাকে পাঠায় সে ভাল কিছু করে আনতে পারে না। সে আর ওই ব্যক্তি কি সমান, যে ন্যায়ের আদেশ করে এবং সে সরল পথে প্রতিষ্ঠিত? (সূরা নাহ্ল, আয়াত-৭৬)
ব্যাখ্যা: উক্ত আয়াতের وهوكل على مولهএর ব্যাখ্যায়, ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে জারীর তাবারী রহ. (৩১০ হি.)বলেন,
وهوعيال على ابن عمه وحلفائ هوأهل ولايته, فكذلك الصنم كل علي من يعبده يحتاج ان يحمله,ويضع هويخدمه, كالابكم من الناس الذى لايقدر على شيئ, فهو كل على اولياءه من بنى اعمامه وغيرهم
অর্থাৎ সে তার পিতৃব্য পুত্র, চুক্তিবদ্ধ মিত্র এবং অভিভাবকদের বোঝা স্বরূপ তথা পরনির্ভশীল। অনুরূপভাবে মূর্তি পুজকদের জন্য মূর্তি বোঝা স্বরূপ, পূজারীর বহন করা, রাখা ও তার সেবার মুখাপেক্ষী হলো মূর্তি। যেমন বোবা যে কোন কিছুরই শক্তি রাখে না সে তার অভিভাবক তথা পিতৃব্যপুত্র এবং অন্যদের জন্য বোঝা স্বরূপ। (তাফসীরে তবারী ৭/৬২৩ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
সাহায্যকারী ও অভিভাবক অর্থে
৯.
ইরশাদ হয়েছে- وان تولوافاعلمواا ن الله مولكم- نعم المولى ونعم النصير
(তরজামা) ঃ যদি তারা না মানে তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ই তোমাদের অভিভাবক, কতইনা উত্তম অভিভাবক তিনি এবং কত উত্তম সাহায্যকারী । (সূরা আন্ফাল, আয়াত-৪০)
ব্যাখ্যা:তাফসীরে ইবনে কাসীরে (২/৩১০ দারুল মানার) বলা হয়েছে ان الله مولكم وسيدكم وناصركم على اعدائكمঅর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক ও প্রভূ এবং তোমাদের শত্রুদের মোকাবেলায় সাহায্যকারী।
ব্যাখ্যা: আল্লামা আলুসী রহ. বলেন-
فاعلمواان الله مولكم أى ناصركم فتثقوابه, ولاتبالوابمعاداتهم
অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের সাহায্যকারী তোমারা তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করবে। আর তাদের (কাফির ও মুশরিকদের) শত্রুতা ও বিরোধিতার পরোয়া করবে না।
উত্তরাধিকারী অর্থে
১০.
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন ঃ ولكل جعلناموالى مماترك الوالدان والاقربون
অর্থাৎ ঃ পিতা মাতা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তির প্রত্যেকটির জন্য আমি উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করেছি। (সুরা নিসা, আয়াত-৩৩)
ব্যাখ্যা: موالى এর ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর রহ. বলেন
قال ابن عباس ومجاهد وسعيدبن جبيروابوصالح وقتادةوزيدبن اسلم والسدى والضحاك ومقاتل بن حيان وغيرهم فى قوله ولكل جعلناموالى أى ورثة
অর্থাৎ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইবনে যুবায়ের, আবু সালেহ, কাতাদাহ, যায়েদ ইবনে আসলাম, সুদ্দী, দাহহাক, মুকাতেল ইবনে হায়্যান প্রমুখ موالى এর ব্যাখ্যায় বলেন “উত্তরাধিকারী” (ইবনে কাসীর ১/৪৭৩ দারুল মানার)
ব্যাখ্যা: তাফসীরে কাবীরে (১০/৭৭) ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. বলেন أى ولكل واحدجعلناورثة فى تركتهঅর্থাৎ প্রত্যেকর জন্য আমি তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী নির্দিষ্ট করেছি।
পাঠক লক্ষ্য করেছেন যে, এসকল আয়াতে কারীমায় মাওলা বা মাওলানা শব্দটি কোথাও অভিভাবক ও বন্ধু অর্থে কোথাও স্বজন বা স্বগোত্র অর্থে কোথাও কর্মবিধায়ক ও মালিক অর্থে কোথাও পালন কর্তা অর্থে কোথাও বা মুনিব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব মাওলা শব্দের একাধিক অর্থ কুরআন মজীদ দ্বারাই প্রমাণিত হল।
হাদীসে “মাওলা” এবং “মাওলানা” শব্দের ব্যবহার
হাদীসেও “মাওলা” এবং “মাওলানা” শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যাবহারিত হয়েছে। নি¤েœ তা উল্লেখ করা হলো-
আযাদকৃত গোলাম ও বন্ধু অর্থে
১.
বারা ইবনে আযিব রহ. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ রা. কে লক্ষ্য করে বলেন انت اخوناومولاناঅর্থাৎ তুমি আমাদের ভাই ও আমাদের বন্ধু। (সহীহ বুখারী ১/৫২৮)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন-
قوله أنت أخونا أي باعتبار أخوة الإسلام والمراد بقوله ومولانا المولى الأسفل لأنه أصابه سباء فاشتري لخديجة رضي الله تعالى عنها فوهبته للنبي وهو صبي فأعتقه وتبناه
(অর্থ) তুমি আমাদের ভাই অর্থাৎ ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বিবেচননায়। আর مولاناদ্বারা উদ্দেশ্য হলো আযাদকৃত গোলাম। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বন্দী অবস্থায় পেয়ে খাদীজা রাঃ এর জন্য ক্রয় করেন। আর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য তাকে হিবা করেদেন। যায়েদ রাঃ ছিলেন তখন বালক, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে আযাদ করে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় তিনি অন্যত্র বলেন,
قوله وقال لزيد أنت أخونا يعني في الإيمان ومولانا يعني من جهة أنه أعتقه وهو المولى الأسفل. (عمدةالقارى۱۳/۲۷۷)
অর্থাৎতুমি ঈমানের বিবেচনায় আমাদের ভাই। আর আযাদ করার বিবেচনায় “মাওলানা” কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে আযাদ করেছেন, আর যায়েদ হলেন আযাদকৃত।
পর্যালোচনা ঃ
গায়ের মুকাল্লিদ বন্ধুদের দাবী অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কাউকে মাওলানা বলা যদি শিরক হয়। তাহলে খোদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কি এরূপ কাজে লিপ্ত হয়েছেন? (নাউযু বিল্লাহ)।
আযাদকৃত গোলাম অর্থে
২.
عن انس بن مالك عن النبى صلى الله عليه وسلم قال مولى القوم من انفسهم .
অর্থ ঃ আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) এর সূত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোন কাওমের (আযাদকৃত) গোলাম তাদেরই অর্ন্তভুক্ত। (সহীহ বুখারী ২/১০০০)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী (রঃ) বলেন- مولى القوم من انفسهم والمرادبه المولى الاسفل لاالاعلى.
অর্থাৎ مولىদ্বারা আযাদকৃত গোলাম উদ্দেশ্য, আযাদকারী উদ্দেশ্য নয়। (উমদাতুল কারী ১৬/৮৪)
আল্লামা আইনী রঃ (باب امامةالعبدوالمولى) এর ব্যাখ্যায় বলেন ঃ
اى هذاباب فى بيان حكم امامةالعبدوالمولى وارادبه المولى الاسفل وهوالمعتوق وللفظ المولى معان متعددةوالمرادبه هناالمعتوق.
অনুচ্ছেদঃ গোলাম ও আযাদকৃত গোলামের ইমামতি। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ গোলাম ও আযাদকৃত গোলামের ইমামতির হুকুম বর্ণনা প্রসংগে, আর মাওলা দ্বারাা উদ্দেশ্য হলো আল মাওলাল আসফাল তথা আযাদকৃত গোলাম, মাওলা শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে এখানে মাওলা দ্বারা আযাদকৃত গোলাম উদ্দেশ্য। (উমদাতুল কারী ৫/২২৫)
সাহায্যকারী ও অভিভাবক অর্থে
৩.
(উহুদ যুদ্ধের এক পর্যায়ে) আবু সুফিয়ান বললো হুবালের জয়, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগনকে বললেন, তোমরা তার উত্তর দাও।তারা বললেন, আমরা কি বলব? তিনি বললেন, তোমরা বল الله اعلى واجل অর্থাৎ আল্লাহ ্সমুন্নত ও মহান। আবু সুফিয়ান বললো। لناالعزى ولاعزى لكم আামদের উয্যা আছে তোমাদের উয্যা নেই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা তার জবাব দাও। তারা বললেন, আমরা কি জবাব দেব তিনি বললেন, বল الله مولاناولامولى لكمঅর্থাৎ আল্লাহ আমাদের অভিভাবক, তোমাদের তো কোন অভিভাবক নেই। (সাহীহ্ বুখারী ২/৫৭৯)
ব্যাখ্যা: আল্লামা আইনী রহ. (৮৫৫ হিঃ) তার বিখ্যাত বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ উমদাতুল কারীতে (১৭/১৪৩) লিখেন-
قوله الله مولاناولامولى لكم اىالله ناصرناولاناصرلكم অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের সাহায্যকারী আর তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই।
মনিব বা অভিভাবক অর্থে
৪.
(ক)
হযরত আবু হুরাইরা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে,
لايقل احدكم اطعم ربك وضئ ربك اسق ربك وليقل سيدى ومولاى ولايقل احدكم عبدى وامتى وليقل فتاى وفتاتى وغلامى.
অর্থ ঃ তোমাদের কেউ যেন এমন কথা না বলে, তোমার রব তথা প্রভূকে আহার করাও। তোমার রবকে উযূ করাও। তোমার রবকে পান করাও। আর যেন (গোলাম বাদী বা অধীনস্থরা) এরূপ বলে “আমার মনিব” “আমার অভিভাবক” তোমাদের কেউ যেন এরূপ না বলে “আমার আবদ” বা দাস, “আমার দাসী” বরং বলবে “আমার বালক” “আমার বালিকা” “আমার খাদিম”। (সহীহ্ বুখারী ১/৩৪৬)।
ব্যাখ্যা: কাযী ইয়াজ রহ. (৫৪৪হি.) তাঁর অনন্য গ্রন্থ ‘ইকমালুল মু‘লিম ফী শরহি সহীহি মুসলিমে’ (৭/১৮৯ পৃ. দারুল ওয়াফা) উল্লেখ করেন-
……فإن المولى : الناصر ، والمولى والمنعم بالعتق والمنعم عليه وابن العم والحليف ، وهى لفظة منصرفة مستعملة فى القرآن والحديث فى هذه المعانى ، فأبيح هنا ذكرها فى حق العبد لسيده لكثرة استعماله فى المخلوقن فى معنى الولاية والقيام بالأمر والإنعام ،
অর্থাৎ মাওলা অর্থ সাহায্যকারী, আভিভাবক, গোলাম আযাদকারী, পুরুস্কৃত ব্যক্তি বা অনুগ্রহের পাত্র, পিতৃব্য পুত্র এবং কোন বিশেষ অঙ্গীকারাবদ্ধ বন্ধু। এ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে এ সব অর্থে ঘুরে ফিরে ব্যবহার হয়। এখানে গোলাম তার মনিবকে মাওলা বলা বৈধ হয়েছে। কেননা এ শব্দটি মাখলুকের ক্ষেত্রে, কর্তৃত্ব বা শাসন, কোন বিষয়ের আঞ্জাম দেয়া বা তত্ত্বাবধান করা, দান ও অনুগ্রহ ইত্যাদি অর্থে অধিক ব্যবহার হয়।
পর্যালোচনা ঃ
মনিবকে মালিক তথা কর্তা অর্থে রব বলা এবং দাসকে সেবক অর্থে বান্দা বলা মূলত বৈধ হলেও এ বৈধতার সুযোগে যেন মানুষ শব্দগত ও অর্থগত কোন ভাবেই শিরকী বিশ্বাসের দিকে ধাবিত না হয় সে পথ রোধ কারার জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাইয়্যেদী তথা আমার নেতা ‘মাওলায়া’ তথা আমার অভিভারক ইত্যাদি শব্দে সম্বোধন করতে শিক্ষা দিলেন আর এখন এ মাওলা শব্দ ব্যবহার করা হয়ে গেল শিরক! তাহলে তো সাইয়্যেদ শব্দ ব্যবহার করাকে ও শিরক বলতে হবে। এরই নাম কি হাদীসের অনুসরণ? (দেখুন ইলামূল মুওয়াক্কিয়ীন ৩/১১৩)
(খ)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ইরশাদ করেন-
عبد اطاع الله , وأطاع مواليه ادخله الله الجنة قبل مواليه بسبعين خريفا, فيقول اليسد: يا رب هذا كان عبدى فى الدنيا, قال: جازيته بعمله وجازيتك بعملك. (انظر التيسير بشرح الجامع الصغير- (حرف العين) (2/126 مكتبة الامام الشافعى الرياض) طب عن ابن عباس باسناد حسن
অর্থ ঃ যে গোলাম আল্লাহর ও তার মনিবদের আনুগত্য করবে। আল্লাহ তাআলা তাকে তার মনিবদের সত্তর বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। মনিব বলবে, ইয়া রব, এ তো দুনিয়াতে আমার গোলাম ছিল। আল্লাহ বলবেন, আমি তাকে তার আমলের প্রতিদান দিয়েছি। আর তোমাকে তোমার আমালের প্রতিদান দিয়েছি। (আল মু’জামূল কাবীর হাদীস ৬/১১১ হাদীস নং ১২৬৩৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ।)
(গ)
عن عائشة قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أيماأمرأةنكحت بغيراذن مواليهافنكاحهاباطل, ثلاث مرات
আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি কোন স্ত্রীলোক অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত কাউকে বিবাহ করে তবে তার বিবাহ বাতিল (পরিত্যক্ত) হবে। আর তিনি এই উক্তিটি তিন বার উচ্চারন করেন। (সুনানে আবু দাউদ ১/২৮৪)
এছাড়া নিম্নোক্ত হাদীস গ্রন্থে ও হাদীসটি بغيراذن مواليهاশব্দে এসেছে। (বায়াহাকী, সুনানে কুবরা -১০/২৯২ হাদীস নং-১৩৮৯৫ ও ১৩৮৯৬, দারুল ফিকর ,মুসনাদে আহমদ- ৪২/২০০পৃ. হাদীস নং-২৫৩২৬, মুয়াছ্ছাছাতুর রিছালাহ)
ইমাম নাসায়ীর সুনানে কুবরাতে হাদীসটি ايماامرأةنكحت بغيرمولاها শব্দে বর্ণিত হয়েছে।(হাদীস ৫৩৯৪)
ব্যাখ্যা: এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম বায়হাকী রহ. (সুনানে কুবরা বায়হাকীতে ১০/২৯২পৃ. হাদীস নং-১৩৮৯৬) আবু উবায়দা র. এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলেন,ارادبالمولى الولىঅর্থাৎ মাওলা দ্বারা অভিভাবক উদ্দেশ্য।
বন্ধু ও কল্যাণের জিম্মাদার অর্থে
৫.
হযরত আবু আইয়ুব রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঃ
الانصار ومزينة وجهنية وغفار واشجع ومن كان من بنى عبد الله موالى دون الناس والله ورسوله مولاهم-
অর্থ ঃ আনসার, মুযয়ানা, জুহায়না, গিফার, আশজা এবং বনু আব্দুল্লাহ আমার বন্ধু লোক, অন্যরা নয়। আর আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল এদের অভিভাবক। (সহীহ মুসলিম ২/৩০৬)
ব্যাখ্যা: الله ورسولهم ولاهم এর ব্যাখ্যায় ইমাম নববী রঃ বলেন
اى وليهم والمتكفل بهم وبمصالحهم وهم مواليه اى ناصروه والمختصون به .
অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদের বন্ধু, তাদের ও তাদের কল্যানের জিম্মাদার। আর তারা তাঁর মাওয়ালী তথা সাহায্যকারী এবং বিশিষ্ট জন। (সহীহ মুসলিমের সাথে সংযুক্ত ইমাম নববীর শারাহ ২/৩০৭)
সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক অর্থে
৬.
হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন
قريش والانصاروجهينه ومزينةواسلم واشجع وعفارموالى ليس لهم مولى دون الله ورسوله
অর্থঃ কুরাইশ, আনসার জুহায়না, মুযায়না, আসলাম, আশজা, গিফার আমার বন্ধুলোক। আর আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল ব্যতীরেকে তাদের কোন অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক নেই। সহীহ বুখারী ১/৪৯৭
ব্যাখ্যা: আল্লামা আইনী (রঃ) বলেন-
والمولى وان كان له معان كثيرة لكن المناسب هناالناصروالولى والمتكفل بمصالحهم والمتولى لامورهم
অর্থ ঃ মাওলা শব্দের যদি ও অনেক অর্থ রয়েছে কিন্তু এ হাদীসে সাহায্যকারী, অভিভাবক, তাদের কল্যানের যামিন এবং তাদের তত্ত্বাবধায়ক ইত্যাদি অর্থই উপযোগী। (উমদাতুল কারী ১৬/৭৬)
৭.
এছাড়াও নও মুসলিমরা গোত্রগত মর্যাদা লাভের জন্য কোন কোন গোত্রে সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সেই গোত্রের অর্ন্তভূক্ত হলে তাদেরকে সেই গোত্রের মওয়ালী আখ্যায় অভিহিত করা হয়।
সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাঃ এর مولانا শব্দ ব্যবহার
আত তাবাকাতুল কুবরা লি ইবনে, সা’দ (৫/২২৫ হাসান বসরীর জীবনী নং-৩০৪৮, দারুল ফিকর )
গ্রন্থে রয়েছে -
ان انس بن مالك سئل عن مسئلة قال:عيلكم مولاناالحسن فسلوه,فقالوايااباحمزةنسئلك وتقول سلوامولاناالحسن!فقال:اناسمعناوسمع فحفظ ونسينا .
আনাস ইবনে মালিক রাঃ কে একটি মাসআলার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন। তোমরা “আমাদের মাওলানা” হাসানের কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করো। তারা বললো হে আবু হামযা (আনাস ইবনে মালিকের কুনিয়াত) আমরা আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করছি আর আপনি বলছেন “আমাদের মাওলানা” হাসানের কাছে জিজ্ঞাসা কর” তিনি বললেন, আমরাও শুনেছি আর তিনিও শুনেছেন, তিনি মুখস্থ করেছেন আর আমরা ভূলে গেছি। (আরো দেখুন তাহযীবুল কামাল হাসান বসরীর জীবনী নং-১২১৬ )
আরবী ভাষাবিদদের নিকট মাওলা শব্দের অর্থ
মাওলা শব্দটি মূলত মাসদার কিন্তু এর দ্বারা اسم فاعلউদ্দেশ্য। (দেখুন তাফসীরে রূহুল মায়ানী ৩/৯৬) আরবী অভিধানসমূহে মাওলা শব্দের রব তথা মহান প্রতিপালক অর্থ ছাড়াও আরো অনেক অর্থ রয়েছে। বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থ “আল কামূসূল মুহীত”-(৪/৫৮৩ পৃ.) এ এ মাওলা শব্দের একুশটি অর্থ লিখা আছে, যা নিম্নে প্রদত্ত হলো ১। – المالكমালিক/কর্তা ২।العبد-গোলাম ৩।المعتق-গোলাম আযাদকারী ৪।المعتق-আযাদকৃত গোলাম ৫। – الصاحبসাথী বা বন্ধু ৬।- القريب নিকটাত্মীয়(যেমন, পিতৃব্য পুত্র বা এ জাতীয় অন্য কেউ ৭।- الجارপ্রতিবেশী ৮।الحليف-কোন বিশেষ অঙ্গীকারবদ্ধ বন্ধু ৯।- الابن পুত্র ১০। – العم চাচা বা পিতৃব্য ১১। – النزيل মেহমান বা আগন্তুক ১২।-الشريك অংশীদার ১৩। – ابن الاخت ভগ্নিপুত্র ১৪। -الولى অভিভাবক ১৫।- الربমহান প্রতিপালক ১৬। – الناصرসাহায্যকারী ১৭।- المنعم পুরুষ্কার দাতা বা অনুগ্রহকারী ১৮।- المنعم عليه পুরুস্কৃত ব্যক্তি বা অণুগ্রহের পাত্র ১৯।- المحب প্রেমিক ২০।- التابع অধীনস্থ ২১। – الصهر বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়তা।
এ গুলোর মধ্যে একমাত্র রব তথা মহান প্রতিপালক ছাড়া অন্য সকল অর্থেই যে কোন মানুষই ‘মাওলা’ হতে পারে।
যে অর্থে আমরা ‘মাওলানা’ শব্দটি ব্যাবহার করে থাকি
মাওলা শব্দের ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং প্রত্যয়যুক্ত শব্দ সচারচার পদবী ও সম্মান সূচক সম্বেধনের শব্দরূপে ব্যবহার মুসলিম জগতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত আছে। আর আলেমদেরকে যে “মাওলানা” বলা হয় তা নেতা, সাহয্যকারী বা অভিভাবক অর্থেই বলা হয়। কেননা উলামায়ে কিরামই আমাদের ধর্মীয় নেতা বা অভিভাবক এবং শরয়ী বিষয়ে অজ্ঞ মানুষদের জন্য সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে তারাই সাহায্যকারী।
আবার “অসাধারন গুণগরিমার স্বীকৃতি হিসাবেও এ শব্দটি ব্যবহার হয়। যেমন জালালুদ্দীন রুমীকে তার নানাবিধ অপূর্ব গুনের অধিকারী হওয়ার কারনে “মাওলানা” পদবীতে ভূষিত করা হয়। যেমনটি করেছেন তুর্কি লেখক সাদুদ্দিন”। (দেখুন সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ ২/১২৭।)
অতএব এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেল যে, ‘মাওলানা উপাধি ব্যবহারে কোনরূপ শিরক, কুফুর বা গুনাহের আশংকা নেয়। কেননা মানুষ রব অর্থে মাওলানা শব্দ ব্যবহার করে না।
আমাদের দেশে আলেমদের ক্ষেত্রে মাওলানা এর মত আরেকটি শব্দ ব্যবহার করা হয় যথা মৌলবী। এ শব্দটির অর্থ হলো যাহেদ তথা দুনিয়া বিরাগী ব্যক্তি কিংবা বড় আলেম ও পন্ডিত। মূল শব্দ হলো ‘মাওলা’ তার সাথে নিসবতী ياء যুক্ত করা হয়েছে।
বৃটিশ আমলে মৌলবী শব্দের ব্যবহার
বৃটিশ বাংলার সুধী মহলে শিক্ষিত হিন্দুদের নামের সাথে শিষ্টাচার স্বরুপ ‘বাবু’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হতো। আজও সেই প্রচলনটা রয়েছে।অন্যদিকে মাদরাসায় শিক্ষা প্রাপ্ত আলেম না হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের নামের সাথে সৌজন্য স্বরুপ সাধারনত ‘মৌলবী’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। আজকাল যেখানে ‘জনাব’ শব্দটি ব্যবহার কর হয়ে থাকে। মাদ্রাসা-শিক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম বিষয়ে বিজ্ঞ বা আলেমদের বেশভূষায় সজ্জিত থাকতেন বলে বৃটিশ বাংলায় অনেকে মৌলবী বলে আখ্যায়িত ছিলেন। যেমনটা কোন কোন ক্ষেত্রে আজও হয়ে থাকে।
লামাযহাবী আলেমদের লিখিত কিতাবে “মাওলানা” শব্দের ব্যবহার
এ মূহুর্তে আমাদের সামনে গায়ের মুকাল্লিদ আলেম লিখিত একটি কিতাব আছে। কিতাবটির নাম سبيل الرسول কিতাবটি প্রকাশিত হয়েছে ই’তেকাদ পাবলিকেশন্স হাউস, নিউ দিল্লী থেকে। প্রথম সংস্করণ ১৯৯৭ ঈ.। লেখকের নাম এভাবে লেখা হয়েছে حضرت مولاناحكيم محمدصاحب سيالكوٹیকিতাবের সূচীতে আলেমদের নামের পূর্বে মাওলানা লেখার কিছু নমুনা উখে করা হল।
- حضرت مولاناثناءالله امرتسرى كاارشاد
- حضرت مولانامحمدابراهيم صاحب سيالكوٹی كاارشاد
- حضرت مولانااسماعيل كاارشاد
- مولاناعبدالحى لكهنوى كاارشاد
লামাযাহাবীদের বড় আলেম ছানাউল্লাহ অমৃতসরী তার ফতওয়ায়ে ছানায়িআহ তে অসংখ্য জায়গায় আলেমদের নামের পূর্বে “মাওলানা” শব্দ ব্যবহার করেছেন। এমনকি তার নিজের নামের পূর্বেও “মাওলানা” শব্দ লেখা রয়েছে। তাদের লিখিত কিতাবে এ ছাড়া আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
শেষ কথা
উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা একথা দীবালোকের ন্যায় পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হল যে, আলেম উলামাদের “মাওলানা” বলা সম্পূর্ণ জায়েজ। এতে কোন সন্দেহ নেই। লা-মাযহাবীরা অহেতুক মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ প্রোপাগান্ডা করে যে, মাওলানা বলা জায়েজ নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের লা-মাযহাবীদের ধোঁকা প্রতারণা ও ওয়াসওয়াসা থেকে হিফাযত করুন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন