বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হাজির নাজির মানে কি?

হাজির ও নাজির উভয় শব্দই আরবী। হাজির অর্থ হল উপস্থিত। আর নাজির অর্থ হল দ্রষ্টা। তথা যিনি দেখেন।
আল্লাহ তাআলা কি হাজির নাজির না রাসূল সাঃ?
রেজাখানী মতাদর্শী বেদআতি গ্র“পের আক্বীদা হল আল্লাহ তাআলা হাজির নন।
পাকিস্তানের রেজাখানী বেরেলবী গ্রুপের আলেম আহমাদ ইয়ারখান গুজরাটী তার রচিত জাআল হক্ব গ্রন্থে লিখেন-“প্রতি স্থানে হাজির হওয়া এটা আল্লাহ তাআলার সিফাত কখনোই নয়। আল্লাহ তাআলা স্থান থেকে পবিত্র। {জাআল হক্ব ওয়া যাহাক্বাল বাতিল-১৬১}
আহমাদ ইয়ারখান সাহেব এর পর লিখেন-“আল্লাহ তাআলা প্রতিটি স্থানে বিদ্যমান মানাটা বদ্বিনী। প্রতি স্থানে বিদ্যমান হওয়াটা এটা রাসূল সাঃ এরই শান। {জাআল হাক্ব ওয়াযহাক্বাল বাতিল-১৬২}
সহীহ আক্বিদা
আল্লাহ তাআলা সর্বত্র বিরাজমান তথা হাজির। কিন্তু কিভাবে হাজির তা আমাদের জানা নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সর্বত্র হাজির থাকার উপর কুরআনে কারীমে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যেমন-
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ [٢:١٨٦]
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে। {সূরা বাকারা-১৮৬}
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ [٥٠:١٦
আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। {সূরা কাফ-১৬}
فَلَوْلا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لا تُبْصِرُونَ (85
অতঃপর যখন কারও প্রাণ কন্ঠাগত হয়। এবং তোমরা তাকিয়ে থাক, তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। (সূরা ওয়াকিয়া-৮৭, ৮৪, ৮৫)
وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ [٢:١١٥]
পূর্ব ও পশ্চিম আল্লারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাক্বারা-১১৫}
قوله تعالى { وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَمَا كُنتُمْ } [ الحديد : 4
তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন {সূরা হাদীদ-৪}
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَىٰ ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَىٰ مِنْ ذَٰلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا ۖ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ [٥٨:٧]
আপনি কি ভেবে দেখেননি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যক্তির এমন কোন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থ না থাকেন এবং পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে তিনি ষষ্ঠ না থাকেন তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশী হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সাথে আছেন, তারা যা করে, তিনি কেয়ামতের দিন তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (সূরা মুজাদালা-৭)
উদাহরণত কিছু আয়াত উপস্থাপন করা হল। এরকম আরো অনেক আয়াতে সরাসরি প্রমাণ করে যে,আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু বিরাজমানতার অবস্থা কি? এটা আমাদের জানা নেই। এটা আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
সুতরাং বুঝা গেল সর্বত্র বিরাজমানতা তথা হাজির থাকাটা এটা আল্লাহর সিফাত। এ সিফাত অন্যের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা সুষ্পষ্ট শিরকী আক্বিদা।
নবী হাজির নাজির হওয়া মুসলমানদের নয় খৃষ্টানদের আক্বিদা
খৃষ্টানদের আক্বিদা হল হযরত ঈসা আঃ সর্বত্র বিরাজমান, তথা হাজির নাজির। যেমনটি লিখেছেন খৃষ্টান পাদ্রী ইমাদুদ্দীন তার রচিত “তাফতীশুল আওলীয়ায়। তিনি লিখেন- ঈসা আঃ প্রত্যেক স্থানে হাজির ও নাজির। {তাফতীশুল আওলিয়া-১০৮}
খৃষ্টানদের আক্বিদা হল যে মজলিস ঈসা আঃ এর নামে করা হয়, সেখানে ঈসা আঃ উপস্থিত হন।
ঈসা আঃ বলেন-“কেননা যেখানে দুই অথবা তিনজন আমার নামে একত্র হয়, সেখানে আমি তাদের মাঝে উপস্থিত হই”। {ইঞ্জিল, মথি, অধ্যায় ১৮, পরিচ্ছেদ-২০}
কোন সৃষ্টিকে সর্বত্র হাজির নাজির বিশ্বাস করা এটা খৃষ্টানদের আক্বিদা মুসলমানদের আক্বিদা নয়।
শরীয়তের দৃষ্টিতে সর্বত্র হাজির নাজির হওয়া এবং সর্বত্র বিদ্যমান হওয়া এটা শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথেই খাস। সৃষ্টিজীবের মাঝে এ সিফাত কখনোই নেই।
একটি উদ্ভট যুক্তি ও তার খন্ডন
মাওলানা আহমাদ ইয়ারখান রেজাখানী বেরেলবী বলেন-“হাজীর হওয়া আল্লাহ তাআলার সিফাত নয়। কারণ হাজির অর্থ হল যিনি আগে ছিলেন না, এখন এসেছেন, আর এমন বিশ্বাস আল্লাহ তাআলা ক্ষেত্রে বলা কিছুতেই জায়েজ নয়, আর নাজির হল দ্রষ্টা। আল্লাহ তাআলারতো কোন চোখই নাই, তাই তিনি আমাদের মত দেখবেন কিভাবে? তাছাড়া হাজির নাজির যদি আল্লাহর সিফাতই হইতো, তাহলে আল্লাহর নিরান্নবই নামের মাঝে এ সিফাতের কথা থাকতো। অথচ তা নেই। সুতরাং বুঝা গেল যে, এটা আল্লাহ তাআলার সিফাত নয়। বরং এটি মাখলুকের সিফাত। তাই এ সিফাতের অধিকারী হলেন রাসূল সাঃ ও বুজুর্গানে দ্বীন। {দ্রষ্টব্য-জাআল হক্ব ওয়া জাহাক্বাল বাতিল-১৫৩}
প্রথম জবাব
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলা কোন স্থানের মুখাপেক্ষি নন, সেই সাথে আল্লাহ তাআলার প্রসিদ্ধ নাম হল ৯৯টি।
কিন্তু কথা হল এ ৯৯ নাম ছাড়া আল্লাহ তাআলার কি আর কোন নাম নেই? একটু চোখ খুলে দেখুন-
১-
আল্লামা নববী রহঃ শরহে মুসলিমের ২ নং খন্ডের ৩২২ নং পৃষ্ঠায়, আল্লামা খাজেন রাহঃ তাফসীরে খাজেনের ২ নং খন্ডের ২৬৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেন যে, “সমস্ত ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহ তাআলা সকল নাম কেবল এ ৯৯টিই নয়, বরং এছাড়াও আছে।
২-
(একথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম নববী রহঃ লিখেন) ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী রহঃ আল্লাহ তাআলা এক হাজার নাম একত্র করেছেন। এর পর তিনি স্পষ্টই লিখেছেন যে, وهذا قليلতথা “এটাও অনেক অল্প”।
৩-
ইমাম রাজী রহঃ লিখেন যে, ওলামায়ে কেরামের নিকট আল্লাহ তাআলার এক হাজার নাম প্রসিদ্ধ ও পরিচিত। যা কিতাবুল্লাহ ও হাদীসে পাওয়া যায়। {তাফসীরে কাবীর, মুকাদ্দামা-১/৩}
৪-
হাফেজ ইবনে কাসীর রহঃ বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তাআলার ৫ হাজার নাম আছে। যা কুরআনে কারীম, সহীহ হাদীস ও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে বলা হয়েছে। {তাফসীরে ইবনে কাসীর-১/১৯}
যখন সকল ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহর সিফাতী নাম শুধু এ নিরান্নব্বই নামে সীমাবদ্ধ নয়, সেখানে ৯৯ নামে হাজির নাজির সিফাতী নাম না থাকাতে তা বাতিল বলাটা কতটা আহমকীর পরিচয় একটু ভেবে দেখবেন কি?
দ্বিতীয় জবাব
যদি আপনাদের কথা দু’মিনিটের জন্য মেনেও নেই যে,আল্লাহর সিফাতী নাম এ ৯৯ নামে সীমাবদ্ধ। তাহলে আপনাদের কাছে প্রশ্ন যে, আল্লাহর নামসমূহকে কি সহজতার জন্য অন্য ভাষায় অনুবাদ করে বলা জায়েজ আছে? যদি বলেন জায়েজ নেই। তাহলে প্রশ্ন হল যে, আল্লাহ এর অনুবাদ তাহলে খোদা বলা কিভাবে জায়েজ? এটাতো ৯৯ নামের অন্তর্ভূক্ত নয়। অথচ এ অনুবাদ বেরেলবী গ্র“প অহর্নিশি করে বেড়ায়।
যদি বলা হয় যে, আরবীতে ইয়া রব, ইয়া মালিক এর অনুবাদ ফার্সিতে করা হয় খোদা বলে। তাতে কোন সমস্যাতো নেই।
তাইতো আমরা বলি যে, এটা যেমন, তেমনি এখানে দেখে নিতে পারেন যে, ৯৯ নামের মাঝে কোন নামের অনুবাদ হাজির নাজির হয় কি না?
চোখ খুলে মেশকাত শরীফের ১ নং খন্ডের ১৯৯ নং পৃষ্ঠায় দেখুন ইবারতের নিচে শহীদ অর্থ লিখা হয়েছে হাজির। আর প্রসিদ্ধ ডিকশনারী “সাররাহ”এ লিখা হয়েছে যে, শহীদ মানে হাজির ও স্বাক্ষ্য।
এমনিভাবে “বাসীর”এর অর্থ লিখা হয়েছে যে, দ্রষ্টা,তথা নাজির। দেখুন-“সাররাহ”-১৬০।
এখন বলুন! আল্লাহ শহীদ ও বসীর নয় কি? আর শহীদের অনুবাদ হাজির, আর বাসীরের অনুবাদ নাজির জায়েজ আছে কি নেই?
এবার তাহলে বেরেলবী রেজাখানী গ্র“পের ব্যক্তিরা হাদীস ব্যাখ্যাতা ও অভিধানবীদদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে নামতে পারেন কেন তারা শহীদের অনুবাদ হাজির করলেন? কারণ হাজিরতো আপনাদের পরিভাষা অনুযায়ী কেবল ঐ ব্যক্তিই হতে পারে, যিনি প্রথমে ছিলেন না, তারপর এসে গেলেন।
সুতরাং বুঝা গেল যে, তাদের এ যুক্তিটি একটি অজ্ঞতাসূচক খোড়া যুক্তি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন