হাবিবুর রহমান মিছবাহ
সতী-সাধ্বী নারীর সম্ভ্রম হরণ করা যায় না। তার সম্মান নষ্ট করা অতোটা সহজ নয়। সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে সে জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না।
চল্লিশ বছর পূর্বে বাগদাদে এক কশাই ছিলো। ফজরের আগেই সে দোকানে চলে যেতো এবং ছাগল-মেষ যবেহ করে অন্ধকার থাকতেই বাড়ী ফিরতো। একদা ছাগল যবেহ করে বাড়ি ফিরছিলো, তখনো রাতের আঁধার কাটেনি। ফেরার পথে একটি গলির ভিতর থেকে কোনো একজনের কাতর গোঙানি শুনতে পেলো। গোঙানি লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। হঠাৎ একটা দেহের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো। তাকিয়ে দেখলো একজন আহত লোক গুরতর যখমাবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। বাঁচাতে হলে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন। তখনো দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে আহতের শরীর থেকে। তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ছুরিটা তখনো দেহে গেঁথে আছে। কশাই ঝটকা টানে ছুরিটি বের করে লোকটিকে কাঁধে তুলে নিলো চিকিৎসালয় যাওয়ার জন্য। কিন্তু লোকটি পথে এবং তার কাঁধেই মারা গেলো।
এর মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। কশাইয়ের হাতে ছুরি, সদ্য মৃত লোকটির গায়ে তাজা রক্ত, এসব দেখে লোকজনের স্থির ধারণা হলো যে, সে-ই ঘাতক। অতপর তাকে খুনি হিসাবে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলো। যখন ‘ক্বিছাছ’ তথা ফাঁসির কাষ্টে আনা হয় রায় কার্যকরের জন্য, তখন সে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, হে উপস্থিত জনতা! আমি এই লোকটিকে মোটেই হত্যা করিনি। তবে আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি অপর একটি হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিলাম। আজ যদি আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়, তাহলে তা এই ব্যক্তির হত্যার কারণে নয়, বরং সেই হত্যাকান্ডের জন্য হতে পারে।
অতঃপর সে বিশ বছর আগের হত্যার ঘটনাটি বলা শুরু করলো-
আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি ছিলাম এক টগবগে যুবক। নৌকা চালাতাম। লোকজনকে পারাপার করতাম। একদিন এক ধনবতী যুবতী তার মাকে নিয়ে আমার নৌকায় পার হলো। পরদিন আবার তাদেরকে পার করলাম। এভাবে প্রতিদিনই আমি তাদেরকে আমার নৌকায় পার করতাম। এ পারাপারের সুবাদে যুবতীটির সাথে আমার আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললাম। এক সময় আমি তার পিতার নিকট বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে গেলে তিনি আমার মতো দরিদ্র এক মাঝির কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। এরপর থেকে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেও এদিকে আর আসতো না। সম্ভবত মেয়েটির বাবা নিষেধ করে দিয়েছিলো। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে ভুলতে পারলাম না। এভাবে কেটে গেল ২/৩ বছর।
একদিন আমি নৌকা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় এক মহিলা ছোট একটি শিশু সঙ্গে নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হয়ে আমাকে নদী পার করে দিতে অনুরোধ জানালো। আমি তাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম। মাঝ নদীতে এসে তাকালাম তার চেহারার দিকে। চিনতে দেরী হলো না যে, এ আমার সেই প্রেয়সী। এর পিতা আমাদের মাঝে বিচ্ছেদের পর্দা টেনে না দিলে সে আজ আমার স্ত্রী থাকতো। আমি তাকে দেখে খুশি হলাম। বিভিন্ন মধুময় স্মৃতির ডালি একে একে তার সামনে মেলে ধরতে লাগলাম। সে প্রতি উত্তর করছিলো খুব সতর্কতা ও বিনয়ের সাথে। পরক্ষণেই সে জানালো যে, সে বিবাহিতা এবং সঙ্গের শিশুটি তারই সন্তান।
আমার মন বড় অস্থির হয়ে গেলো। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। একটি অশুভ ইচ্ছা আমাকে তাড়া করলো। এক পর্যায়ে যৌন পিপাসা নিবৃত্ত করার জন্য আমি তার উপর চাপাচাপি শুরু করলাম। সে আমাকে মিনতি করে বললো, আল্লাহকে ভয় করো! আমার সর্বনাশ করো না। আমি ফিরলাম না। তখন অসহায় নারীটি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করতে লাগলো। তার শিশু কন্যাটি চিৎকার শুরু করলো। আমি তখন তার শিশু কন্যাটিকে শক্ত হাতে ধরে বললাম, তুমি আমার আহবানে সাড়া না দিলে তোমার সন্তানকে আমি পানিতে ডুবিয়ে মারবো। তখন সে কেঁদে উঠলো। হাত জোড় করে মিনতি জানালো। কিন্তু আমি এমনই অমানুষে পরিণত হলাম যে, নারীর অশ্রু ও কান্না কিছুই আমার প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার চেয়ে মূল্যবান মনে হলো না।
আমি নিষ্ঠুরভাবে শিশু কন্যাটির মাথা পানিতে চেপে ধরলাম। মরার উপক্রম হতেই আবার বের করে আনলাম। বললাম জলদি রাযী হও, নইলে একটু পরই এর লাশ দেখবে। কিন্তু যুগপৎ সন্তানের মায়ায় এবং সতীত্বের ভালোবাসায় বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো মেয়েটি, যা আমার কাছে ছিলো অর্থহীন, মূল্যহীন। আমি আবার শিশুটিকে পানিতে চেপে ধরলাম। শিশুটি হাত-পা নাড়ছিলো। জীবনের বেলাভূমিতে আরো অনেক দিন হাঁটার স্বপ্নে দ্রুত হাত-পা ছুঁড়ছিলো। কিন্তু ওর জানা ছিলো না কেমন হিংস্রের হাতে পড়েছে সে। এবার আমি তার মাথাটা তুলে আনলাম না। ফল যা হবার তাই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
আমি এবার তাকালাম শিশুর মায়ের দিকে। কিন্তু মেয়ের করুণ মৃত্যুও তাকে নরম করতে পারেনি। সে তার সিদ্ধান্তে অনড়, অবিচল। তার দৃষ্টি যেনো বলছিলো সন্তান গেছে, প্রয়োজনে আমিও যাবো, জীবন দেবো, তবুও মান দেবো না। কিন্তু আমার মানুষ সত্তা হারিয়ে গিয়েছিলো। বিবেক-সত্তা ঘুমিয়েছিলো গভীর সুপ্তির কোলে। আমার মাঝে রাজত্ব করছিলো শুধু আমার পশু-সত্তা। আমি নেকড়ের মতো তার দিকে এগিয়ে গেলাম। চুলকে মুষ্টি বদ্ধ করলাম। তারপর তাকেও পানিতে চেপে ধরলাম। বললাম ভেবে দেখো! জীবনের মায়া থাকলে আবার ভাবো!। সে ঘৃণাভরে না বলে দিলো। আমিও তাকে চেপে ধরে রাখলাম। এক সময় আমার হাত ক্লান্ত হয়ে এলো। সাথে সাথে তার দেহটাও নিথর হয়ে গেলো।
আমি ওকে পানিতে ফেলে দিয়ে ফিরে এলাম। এ খবর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানলো না। মহান সেই সত্তা, যিনি বান্দাকে সুযোগ দেন। কিন্তু ছুড়ে ফেলে দেন না। এই করুণ কাহিনী শুনে উপস্থিত সবার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। এরপর তার শিরোচ্ছেদ করা হলো।
উক্ত ঘটনা উজ্জ্বল প্রমাণ যে, সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষায় সতী-সাধ্বী নারীরা কতো আপোষহীন? নিজের মেয়েটা নিজের চোখের সামনে জীবন দিলো তবুও সে আপোষ করলো না। নিজের জীবন দিলো তবুও নিজের মান ও সতীত্ব বিসর্জন দিলো না। তার সতীত্ব ও সম্ভ্রমের গায়ে একটি কাঁটাও ফুটতে দিলো না।
একেই নারী বলে। হাজার সালাম তোমায় হে প্রিয় বোন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন